সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দক্ষিণ মৈশুন্দি কিংবা ভূতের গলিতে মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে

পর্ব ১- ডাল অথবা আলু কিংবা ক্ষেতা পুরি


মোহাম্মদ শহীদুল হক ওরফে শহীদুল জহির সাবের সাথে আমার পরিচয় ভূতের গলিতে। এটাকে পরিচয় না বলে বলা ভাল প্রথম সাক্ষাত। আমি ওঁনারে রোজ দেখতাম গলির মোড়ে সন্ধ্যাবেলা চা খাইতে। উঁনি রং চা খাইতেন না দুধ চা খাইতেন কিংবা চায়ে চিনি খাইতেন কিংবা খাইতেন না তা তখন পর্যন্ত আমার জানা হয় নাই অথবা জানার সুযোগ হয় নাই। আমি সন্ধ্যাবেলা গলির মুখে যাইতাম শেফালির সাথে দেখা করতে, সে তখন তাদের পাকঘরের জানালা খুইলা তার মালকিন আর সাহেবের জন্য চা বসাইত। আমি পাকঘরের জানালা দিয়া ফুচকি মারতাম, কখনো কখনো নিরিবিলি গলি মাগরিবের আজানের কারণে ব্যস্ত হয়ে উঠত,মুসল্লিরা টুপি পড়তে পড়তে আমাকে প্রশ্ন করত- ‘কি মিয়া নামাজে যাইবা না’? তারা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই দ্রুত পা বাড়াত। কোন কোন দিন আমি জবাব দিতাম – ‘হ, আইতাছি, নামাজ তো পড়ন লাগব’। শিক দেয়া জানালার ফাঁক দিয়ে আমি শেফালির পানি ধরা ভেজা হাত ধরতাম, কখনো কখনো সেই হাতে সাবান লেগে থাকত, আমি লুঙ্গিতে মুঁছে ফেললতাম সাবান, আবার তার হাত ধরতাম যতক্ষণ না চুলায় চায়ের পানি শুকিয়ে না যেত।
কোন কোন দিন মালকিন সাহেরা আপার চিৎকার আসত- অতক্ষণ লাগেনি চা বানাইতে শেফালি মাগী, কার হাত ধইরা বয়া রইছত? চিৎকার শুনে আমি দৌঁড়াই আর ওমনি এক দৌড়ের প্রাককালে আমি শহীদুল জহির সাবরে দেখতে পাই খুব মনোযোগ দিয়া আলুপুরির সাথে চা খাইতে। আমি কাছে গিয়ে খুব পরিচিত মানুষের মত বলি-হুদাই এরে আলুপুরি কয় ,ভিতরে আলু নাইক্কা।-‘আলু নাইক্কা! হ ঠিক কইছেন, হুদা পুরির ক্ষেতা পুরি’। আমি প্রশ্ন করি-হাজারীবাগের ক্ষেতা পুরি খাইছেন নি? –‘ হ খাইছি’। ‘আবুলেরটা খাইছেন?’ বলে শহীদুল জহির সাবের দিকে তাকায় থাকি এবং নিশ্চিত হয়ে যাই তিনি আবুলের ক্ষেতা পুরি খাননি। জহির সাব মাথা না নাড়িয়েই আলুপুড়ির প্লেটে রাখা শসার টুকরা মুখে পুরেন। ঝাল খাননি? জিগাই, ঝাল খাইবার পারেন নিকি?-‘পারি, ক্ষেতা পুরির কথা কন? গেস্ট্রিকের সমস্যা, ওহন আর খাইনা’। আপনার লাইগা আনমুনে ক্ষেতাপুরি, যাইবেননি হাজারিবাগ? -‘যাওন যায়, লয়েন একদিন’। পুরির দোকানদার আজমল অবাক হয়, সে ভাবে যেই মোহাম্মদ শহীদুল হক ওরফে শহীদুল জহির পুরা ভূতের গলি আর দক্ষিণ মৈশুন্দি’র কারো সাথে বিগত বিশ বছরে যত না কথা বলেছে তার চেয়ে বেশি কথা বলছে এই ভাদাইম্যা মিজানের সাথে। সে চেঁচিয়ে উঠে- ‘ঐ মিজাইন্যা হমুন্দির পুত, ক্ষেতা পুরি খাওয়াবি ভাল কথা, আমার আলুপুরির ভিতরে কেডায় কইছে আলু নাই, এর চেয়ে ভাল আলু পুরি খাইচত নি আর জীবনে’? আজমল মিয়ার কথা শুনে আমি বিভ্রান্ত হই, আসলেই তো এরচেয়ে ভাল আলুপুরি খেয়েছি কিনা মনে করতে পারিনা। আমি বলে উঠি- ‘মিয়া আবুলের ক্ষেতা পুরি খায়া আলাপ চোদায়ো , খাইছনি মিয়া? আজমল এবার আমার কথা শুনে বিভ্রান্ত হয়, তার চেহারা দেখে বুঝা যায় সে মেনে নিয়েছে তার আলু পুরি থেকে হাজারীবাগের আবুলের ক্ষেতা পুরি বেশি মজা আর জনপ্রিয়। আজমল প্রশ্ন করে-‘ চাটনি দেয়নি ক্ষেতা পুরির লগে, আমার বইন জামাই ক্ষেতাপুরির বিজনেস করে মিরপুরে’। -‘ মিরপুর! বহু দূর, কেডায় যায় মিরপুর’? –‘হ মিরপুরে যাওনের টাইম নাইক্কা, হেরে কমুনে একদিন ক্ষেতাপুরি লয়া আইব।
শেফালির হুনলাম বিয়া হয়া যাইব, ওর বিয়া হয়া গেলে তুমি কী করবা’। –‘ কার লগে বিয়া ঠিক হইছে?’ আজমল লুঙ্গির উপর দিয়া পাছা চুলকাইতে চুলকাইতে বলে-‘ওগো গেরামের এক বেডা, বেডা না কয়া চ্যাংরা পোলা কওনি ভাল, তিরিশ বৎছর বয়স, লালবাগে ফ্যাক্টরি আছে’। -কিয়ের ফ্যাক্টরি? ‘ঐ পেলাস্টিকের, বদনা-বুদনা বানায় আর কি!’ আজমলের কথা শুনে আমি আকাশের দিকে তাকাই, আকাশের অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে লাগে না। পাশে শহীদুল জহির সাব চা শেষে একটা সিগারেট ধরান, আমিও তার দেখা দেখি সিগারেট ধরাই। মোহাম্মদ শহীদুল হক ওরফে শহীদুল জহির সাব কিছু না বইলা হাঁটা ধরেন।
-‘মিয়া তুমি ডাইল পুরি বানাইতে পার না? আলু পুরি বানাও ক্যালা?’ ‘ডাইলের দাম বেশি, আর আমার আলুপুরি থিকা স্বাদের আলুপুরি তুমি খাইছ আর’? আজমলের এই কথায় আমি আবারও বিভ্রান্ত হই আর তাকে বলি-‘তাও ডাইল পুরি তো ডাইল পুরি, আলু খাইলে মানুষ মোটা হয়’। আজমল আমার কথায় কান দেয়না, অন্য লোকের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে। আমি আজমলের কাউন্টারে পয়সা রেখে শেফালির জানালার কাছে যাই, অনেকক্ষণ খুট খুট করার পর শেফালি জানালা খুলে ঝাড়ি মারে-‘ আবার আইছ কেলা?’ – ‘তোমার নাকি বিয়া ঠিক হইছে’? ‘কেডায় কইছে, মিছা কথা’। - ‘রাইতে জাগনা থাইকো, ডাকলে দরজা খুইলা দিও’। শেফালি কথা না বলে জানালা লাগিয়ে দেয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

দক্ষিণ মৈশুন্দি কিংবা ভূতের গলিতে মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে (3)

কোথায় পাব তারে  মোহাম্মদ শহীদুল হক সাব ৯-৫টা চাকরি করেন। ৫টার একমিনিটও বেশি সময় তিনি অফিসে দিতে চান না,যদিনা কেউ তার বিপরীত পাশের চেয়ারে বসে না থাকে। উঁনার বিভাগের উঁনি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ায় কাজের গতি ও সময় নির্ধারণ উঁনার হাতেই বর্তায়। আমরা বলতে পারি এই ৯-৫টার মধ্যকার এক ঘন্টা সময়ও উঁনি নষ্ট করেন না, বাইরের অনাকাঙ্খিত কেউ আসলে প্রবেশমুখে পিওন আঁটকে দেয়, বলে দেয় স্যার অফিসে নেই। এটা মোহাম্মদ শহীদুল হক সাব ইচ্ছা করেই করেন; না বলে আমরা বলতে পারি এটা তার অভিজ্ঞতা ও পেশা গত দক্ষতা যে উঁনি উটকো লোক এড়িয়ে চলতে পারেন, আর যেহেতু সরকারি চাকরি তাই এখানে ভোক্তা সন্তুষ্টি বা আম জনতার সাথে সম্পর্ক রাখারও কিছু নেই, প্রাইভেট কোম্পানিতে যেভাবে ক্লায়েন্ট সার্ভিস বা অন্যান্য যোগাযোগ মেনে চলার একটা দায় বর্তায়, সরকারি চাকরিতে এসব থাকে না। প্রতি সোম  আর বুধবার মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে বিভাগীয় প্রধান, সচিবসহ অন্যান্যরা মিটিং করেন রুটিন অনুযায়ী।  মোহাম্মদ শহীদুল হক সাব সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে তাঁর পিতৃ নিবাসে চলে যান, এখানে উঁনি আর কাজের লোক শাহ আলম ছাড়া কেউ থাকে না, শাহ আলম উঁনার ব্যক্তিগত গাড়ি চালকও বট

ট্রলার

পান চিবাইতে চিবাইতে আব্দুর রহমান বাড়ি ফিরে। দুপুরে খাবারের পর সে নিয়ম করে ঘর থেকে বাইর হয়, তা যতই বৃষ্টি হোক কিংবা ঠাডা পড়া রোদই হোক না কেন, রশিদের দোকান থেকে সে পান কিনে, হালকা জর্দা দেয়া, একটু চুন সাথে সুপারি দেয়া অর্ধেক পান খাবে সে এবং শেষ পিকটা ফেলবে সে তার বাড়ির দরজার পাশের দেয়ালে আর এভাবেই ঐ দেয়ালটার নিচের সম্পূর্ণ অংশ সবসময় লাল হয়ে থাকে। আব্দুর রহমান চল্লিশোর্ধ্ব, কোন কারনে সে এলাকায় গরুর ব্যাপারী হিসেবে পরিচিত, তাকে সবাই আব্দুর রহমান বেপারী ডাকে, তবে লোকে তাকে কেন গরুর ব্যাপারী ভাবে সে আজো ঠাওর করতে পারেনা, কোনদিন ঘোর লাগা এক বর্ষার রাতে সে কলিমুদ্দি ব্যাপারীর সাথে তাস খেলতে খেলতে হয়তো গরুর বেপার নিয়ে দুই একটা কথা বলছিল তাতেই কি লোক তাকে ব্যাপারী নাম দিল নাকি তা নিয়ে সে প্রায়ই ভাবে এবং ভাবতে ভাবতে কোন কুল কিনারা না করতে পেরে মাছের ট্রলার আজো কেন ফিরল না সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। আব্দুর রহমানের আসল কাজ মিয়া বাড়ির আটটা ট্রলার দেখা শোনা করা, এবং এই এলাকায় যে আর কারো দুই একটার বেশি ট্রলার সে বাড়তে দেয়না এইটা জানার কারণে মিয়া বাড়ির বড় মিয়া তাকে বেশ স্নেহ করে আর এই স্নেহ মাঝে মধ্যে বাড়

দক্ষিণ মৈশুন্ডি কিংবা ভূতের গলিতে আমরা কয়েকজন একা একা মানবেরা (5)

৫। ভাদাইম্যা মিজান শেফালিকে দূর থেকে দেখে মকবুলের মা , কাছে আসতেই বলে -‘ উদলা হয়া গেছিলা কই ? মাইয়্যা মানুস ঘোমটা ছাড়া ঘর থন বাইর হয় নিকি ?’ শেফালি বিব্রত হয় , ভুলে যায় শাশুড়ির কথা । মকবুলের মা বলে উঠে -‘ তোমার চলন বলন আরো ঠিক কর বউ , আমার পোলা সামনের বছর হজ্বে যাইব নিয়ত করছে , হাজ্বি সাবের বিবি তুমি , ঠিক কইছি না !’ শেফালি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয় । আসলেই শেফালি তো এখন সাহেরা আপার বান্ধা কাজের মেয়ে না , এই বাড়ির বউ । মকবুল এই এলাকার নামিদামি মানুষদের একজন । সে প্রথম প্রথম বুঝতে পারে নাই , এখন যখন আসে পাশে যায় , প্রতিবেশিদের সাথে মিশে তখন জানতে পারে সবাই , বিশেষ করে কসাইভিটা , লালবাগ , জিঞ্জিরা এলাকার লোক মকবুলকে কত মান্য করে । কসাইভিটার প্রত্যেক ঘরে ঘরে মকবুলের কৃতজ্ঞতার জন্য দোয়া করা হয় , ঘরে ঘরে মকবুলের দেয়া কিছু না কিছু থাকে । শেফালি শুনে আর অবাক হয় , নিজেকে ভাগ্যবান ভাবে । আমি ভাদাইম্যা মিজান , সারাদিন টো টো কইরা ঘুরি দেইখা আমার এই নাম । পুরা দক্ষিণ মৈশুন্ডি আর ভূতের গলিতে আমারে সবাই চিনে এই নামে । আমার এই নামের পেছনে যদিও কোন তাৎপর্য নাই কিন্তু তারপরও লোকে ব্যাখ্য