স্টেশন
থিকা ট্রেনটা যখন চলা শুরু করল তখন আমি জানালা দিয়া গলা বাইর করে দিলাম। আস্তে
আস্তে গোবরের গন্ধ,ময়লার গন্ধ,মানুষের গন্ধ নাক থেকে হারায় যেতে লাগল আর নাকে বাড়ি
দিতে লাগল ভেজা খড়,ধান আর পুকুরের মাছের গন্ধ,পানির গন্ধ। ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে
আইসা আমি টিকেট কাটলাম সিলেটের জন্য। শোভন চেয়ার, সিটের হাতল ভাঙ্গা,এইখান সেইখান
থিকা ফোম উইঠা গেছে,মাথার উপরে ফ্যান আছে কিন্তু তার সুইচটা ভাঙ্গা,কখনো সখনো
বাইরের বাতাসে ফ্যানের পাখা ঘুরতে লাগল আর তাতে এক অদ্ভুত শব্দ হইতে লাগল। আমি
ভাবতে লাগলাম সিলেট কতদূর, আবার ফিরা আসতে পারব তো? আমরা থাকি মিরপুর,পীরেরবাগ।
সিলেট আমার দাদাবাড়ি,সারাজীবন বাবা-মা’র সাথে রোজা কিংবা কোরবানির ঈদে চার-পাঁচ
দিনের জন্য সিলেট আসতাম। নানাবাড়ি ঢাকায় হওয়ার কারণে একটা ঈদ ঢাকায় করতে হয়,আরেকটা
সিলেটে। আমার দাদার ধারণা সে খুব শীঘ্রই সে মারা যাবে তাই সব ঈদের আগে তার মনে হয়
এইটাই তার জীবনের শেষ ঈদ। যদিও এখনো তিনি বাঁইচা আছেন,অসুস্থ্য তবে মৃত্যুশয্যায়ী
না।
আমার
এইবার আচানক সিলেত রওনা দেয়ার ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক,কেননা আমি কখনোই এইরকম
একলা সিলেট কী জয়দেবপুর পর্যন্ত যাই নাই। বাপ-মা’ ছাড়া আমি আমার জীবনের কোন দিন
পার করি নাই,এমনকি বাসা থিকা বাইর হওয়ার আগে বইলা বাইর হই কয়টার সময় ফিরব। এইটা
একপ্রকার অনুমতি,পরোক্ষভাবে মা’র কাছ থিকা অনুমতি নেওয়া,তার যদি আপত্তি থাকে তবে
আমি নির্ধারিত সময়ের আগেই ফিরা আসব।
গেল
মাসে সিলেট থিকা ঢাকা আসার সময়ে আমার সাথে এক মেয়ের প্রেম হয়ে গেছে। আমি তারে
চিনিনা,খালি চোখাচোখি হইছে কিন্তু আমার মনে হইতাছে তার সাথে আমার জনম জনমের প্রেম।
আমি উদাস হয়া বাইরে তাকাই,ট্রেন ভৈরব ব্রীজে উঠে। আমি ঘুটুর মুটুর শব্দের সাথে রঙ
চা খাই কাটলেট দিয়া। ছোটবেলা থিকা খায়া আসতাছি একই স্বাদের আর একই সাইজের কাটলেট। চা
খায়া একটা সিগারেট ধরাই,আমি ধোঁয়াগুলারে মেঘের সাথে উঁড়ায় দিতে ভাবি মেয়েটার কথা। ভাবি
মেয়েটার চোখ দুইটার কথা, কী এমন ছিল ঐ দুই চোখে যে আমি তার প্রেমে পড়লাম আর আমারও
মনে হইতে লাগল আমাদের প্রেম হয়া গেছে। গোবিন্দ আর রাভিনা ট্যান্ডনের একটা ছবি
দেখছিলাম। ছবিতে দুইজন দুইজনের দিকে তাকায় থাকে আর তাদের মনে গান বাজে, গান শেষে
তারা ঠিক ঐভাবেই তাকায় ছিল। আমিও রিকশায় ঊঠতে উঠতে মেয়েটারে দেখতে ছিলাম
জিন্দাবাজার মোড়ে,মেয়েটা ঠিক ব্লু ওয়াটার মার্কেটের সামনে নাইমা পড়াতে আমি লাফ
দিয়ে ফুটপাতে নাইমা রিকশাওয়ালার হাতে বিশ টাকার একটা নোট দিয়া রাস্তা পার হয়া
গেলাম।
আমার
ভাবনায় ট্রেনের টিটি ব্যাঘাত ঘটাইল,এই মাঝ রাস্তায় সে কই থিকা উদয় হইল জানতে
চাইলাম। সে আমারে হাইকোর্ট দেখায় বলল এইটাই নাকি নিয়ম,আমি টিকিট দেখায়া আবার একটা
বিড়ি ধরাইলাম। আজকাল বাসে ট্রেনে কেউ সিগারেট খায়না। পাশের সিটের আঙ্কেলও মনে হয়
আমারে দেইখা সাহস পাইল,ব্যাটা এতক্ষন নাক ডাইকা ঘুমাইতেছিল। জিজ্ঞাস করল-খই যাইবা?
আমি সিগারেটটা বাম হাতের আঙুল দিয়া ঢাইকা জানালার বাইরে নিয়া গেলাম। বল্লাম-সিলেট।
-সিলেট খই? –জ্বী টাউন। -তে টাউন খই বা?-জ্বী শিবগঞ্জ। -আইচ্ছা, ঢাকাত কীতা,বেড়ানিত
নি? – জ্বী অয়, বেড়ানিত। আপদটারে সাইড করানোর জন্য আমি সিগারেটে লম্বা টান দিয়া
চাপা শক্ত কইরা রাখলাম, যেন খুব মেজাজ খারাপ,ভদ্রতার মায়রে বাপ। ভদ্রলোক আর কথা
বাড়াইল না ।
ব্লু-ওয়াটার
মার্কেটের উপরে ফাস্টফুডের দোকান, মেয়েটারে ফলো করতে করতে আমি সেই দোকানে ঢুইকা
পড়ছিলাম। সে তার বান্ধবীদের সাথে খাইতে আসছে, বুঝলাম তার জন্মদিন, সবাই হ্যাপি
বার্থডে গান গায়া উঠল, কেক কাটল, আমি দূরের টেবিলে বসলাম। ওয়েটার ম্যানু দিয়া
গেল,আমি ভাব দেখাইলাম কেউ একজন আসবে , আমি যেন তার অপেক্ষাতেই আছি। পকেট থিকা
মোবাইল বাইর করলাম,তখন সেলফির যুগ ছিলনা, ক্যামেরা ওয়ালা মোবাইল কিন্তু আমি ছবি
তুলিনা, ভিজিএ ক্যাম, মার্কেটে সাইবার শট,ফাইভ ম্যাগাপিক্সেল, আমি স্লাইড উঠাই আর
নামাই, তখন এইটাই ভাব। আমি মেয়েটার উলটা দিকে বসছি,অত্যন্ত সুন্দর মেয়ে কিন্তু মুখ
দিয়া যখন বাইর হইল সিলেটি ভাষা আমি হতাশ হয়া পড়লাম। আমার মনে হইল আমি হুদাই টাইম
নষ্ট করছি,এর চেয়ে রাজা ম্যানশনে গিয়া বই কিনাই ভাল। ভাবতে ভাবতে আমি উঠতে যাব এমন
সময় সে শুদ্ধ ভাষায় ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করল তাদের দশজনের কোন সেট ম্যানু আছে
কিনা,ড্রিংক্স আর চিপস কম্বো দিবে কিনা। আমি ঢোক গিলা কফি আর স্যান্ডুইচ অর্ডার
করলাম। মেয়েটার দিকে আমি সরাসরি যতবার তাকাইছি ততোবার সে আমারে খেয়াল করছে, চোখে
চোখ পড়ছে। আমি রোমাঞ্চিত অনুভব করলাম, আমি ভাবলাম –এইতো আমার প্রেম হয়া গেছে, আমি
বিরাট খেলোয়াড়। খেলারাম খেলে যা।
ট্রেন
শ্রীমঙ্গলে আসার পর বাসা থিকা ফোন আসল, আমি আমার মা’রে বললাম-আমি আমার এক বন্ধুর
বাসায় আসছি, রাতে আসব না, মা অবাক হয়া বারবার জিজ্ঞাস করতে লাগল আমি মিথ্যা বলতাছি
কেন, তার ধারণা শক্ত হতে লাগল আমি কোন মেয়ের পাল্লায় পড়ছি আর তারে নিয়া ঢাকার
বাইরে পালায় যাচ্ছি। আমি বললাম –বাসায় ফিরা পুরা কাহিনী বলব,এখন রাখি। পাশের
আঙ্কেল মৌলভীবাজারের লোক, পরে আলাপে জানলাম সে ঢাকায় চাকরি করে, রবি টু বুধ ফুল
অফিস কইরা বৃহস্পতির হাফ ডে-তে সে রওনা দেয় বাড়িতে । ভাবলাম কী নিষ্টূর জীবন, বউ
বাচ্চার জন্য প্রতেক সপ্তাহে আসে, আমার একদিনেই কেমন জানি বিরক্ত লাগতাছে। দুপুরের ট্রেন, পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে রাত ১১টা
বাজল। আমি স্টেশন থিকা রিকশা নিয়া শিবগঞ্জ আমার চাচার বাড়িতে হাজির হয়া গেলাম,
তারা সবাই ঘুমায় পড়ছিলেন। আমারে এইভাবে দেইখা ভাবলেন বুঝি বাড়ি থিকা রাগ কইরা
আসছি। বললাম, একটা চাকরির ইন্টারভ্যিউ,শুইনা তারা খুশি হইলেন এবং আমারে ভরসা দিলেন
যে চাকরিটা আমার অবশ্যই হবে। আমি ঢাকায় পড়াশোনা করা ছেলে আর আমার সিলেটে চাকরি হবে
না তা হতে পারেনা।
সকালে
উইঠাই আমি নাস্তা খায়া জিন্দাবাজার গিয়া হাজির হইলাম। শুক্রবার তাই ব্লু ওয়াটার
মার্কেট খুলে নাই,এরা নাকি শুক্রবারে মার্কেট বন্ধ রাখে। আমি মার্কেট মালিক
সমিতিরে মা-বাপ তুইলা গালি দিয়া রাজা ম্যানশনে গেলাম, বইপত্রের মালিক দম্পতির সাথে
দেখা। তাদের সাথে আমার আগে থিকাই খাতির,কথা বার্তা বলতে বলতে জানতে পারলাম সিলেট
শহর এখন অনেক ব্যস্ত শহর আর প্রচুর নন সিলেটি দিয়া সিলেট ভইরা গেছে। সিলেটের লোকাল
লোকজন বাইরের এই অনাহুত নাগরিকদের পছন্দ করেনা। বড় বড় চাকরি,সরকারি পদ এখন বাইরের
লোকজনের দখলে, আত্মীয়করণে তারা আরো সজাগ, তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী এখন এই সিলেট শহরে
ঘাটি গাড়তাছে চাকরির আশায়। আমি এইসব ফাউ প্যাঁচালের মধ্যে না গিয়া বাইরে যাই,
তারপর মার্কেটের ছাঁদে উঁঠি, সিলেটের শিক্ষিত আর বইপড়া পোলাপাইন, বিশেষ কইরা যারা
ভার্সিটিতে পড়ে তারা এই মার্কেটে বই কিনতে আসে, তাই ছাঁদে তারা চা-বিড়ি ফুঁকে, ছোট
আড্ডা হয়া যায় এক্টা,দুই একজন লেখালেখির জগতে হাত পাকাইতাছে লিটল ম্যাগের মাধ্যমে,
আমি তাদের সিগারেট খাওয়াই, ঢাকায় যাওয়ার দাওয়াত দিয়া ছাঁদ থিকা নাইমা পড়ি। ভাবি ঐ
মাইয়ার সাথে আমার দেখা হবেনা। হুদাই হাঁটতে হাঁটতে চৌহাট্টার মোড়ে যাই,কোনার ফুলের
দোকান থিকা দুইটা গোলাপ কিনি ত্রিশ টাকা দিয়া, ভাবি শাহবাগে এরচেয়ে সস্তায় পাইতাম।
আমারে আমার চাচাতো ভাই ডাক দেয় দূর থিকা আমি হাত দেখায়া সামনে যাই,সে আমারে
আবিষ্কার কইরা মহা পন্ডিতি দেখানো শুরু করে, ভাব এমন সব বুইঝা ফালাইছে, এই
শুক্রবারে কোন ইন্টারভ্যিউ না আমি আসলে নারী ঘটিত কারণের তাদের শহরে আসছি। আমি
তারে পাম-পট্টি মাইরা ভাগাইতেই সেই মেয়ে রিকশা কইরা আমারে ক্রস করল। আমি ভ্যাবলার
মত চায়া শুধু তার হারায় যাওয়া দেখলাম, আর সিলেট শহর এমনি শহর আপনি রিকশা দুই
ঘন্টায়ও পাইবেন না। অগত্যা আমি হাঁটা ধরলাম মেডিক্যাল বরাবর,কারণ মনে হইল সে
ঐদিকেই গেছে।
সিলেট
শহর আসলেই ব্যস্ত, গাড়ি-রিকশার হুরোহুরি কিংবা মানুষের গতি ঢাকার মতোই। আমি হাঁটতে
হাঁটতে মেডিক্যালের সামনে গেলাম, দেখলাম পুরা এলাকা খালি, এই সকাল বেলা দুইটা কাউয়া
ছাড়া আর কেউ নাই। আমি নিরাশ মনে সিগারেট ধরাইলাম, পাশের চায়ের দোকান থিকা চা
খাইলাম, দেখি দুই এক ঘন্টা অপেক্ষা করি। ঐ দিন ব্লু-ওয়াটারের কথা মনে পড়ে। তারে
আমি বারবার দেখার ফলে সে তার দল-বল নিয়া তাড়াহুড়া কইরা খায়া কাইটা পড়ছিল,আমি ভয়ে
আর ফলো করতে পারিনাই। আজকে আমি বখাটে পোলাপাইনের মত আচরন করব, দেখি যা হওয়ার হবে।
কিন্তু আমার আশায় গুড়েবালি হইতে লাগল, আমি তারে পাইলাম না। বহুক্ষণ পর দেখি সে
হাসপাতাল থিকা বাইর হইল, আমি নিজের সিক্স সেন্সে নিজেই অবাক হইলাম। আমি জানিনা,আমি
কেন এইখানেই আসলাম,এইটাও জানিনা সে এইখানে কী করে। আমি তারে ডাকলাম, সে রিক্সা
খুঁজতাছিল, তারে বললাম এইখানে রিক্সা পাবেন না,চলেন সামনে আগায় যাই। সে আমারে
জিজ্ঞাস করল-আমি কী আপনারে চিনি? জবাবে আমি না সূচক মাথা নাড়ায়া বললাম, আমি আপনারে
চিনি, এইটাও জানি আপনে ব্লু-ওয়াটারে ফাস্টফুড খাইতে যান। সে আমারে অবাক কইরা দিয়া
বলল, সেইদিন সে আমারে খেয়াল করছে কিন্তু আমি যে তারে ফলো করি এইটা সে পছন্দ করতেছে
না। আমি তারে পুরা কেস খুইলা বললাম, কিরা কসম কাইটা বললাম আমি তারে ভালবাসি, তার
প্রেমে পইড়া গেছি। আর আমার কখনই কারো সাথে প্রেম হয়নাই এই জীবনে। সে যে আমারে খুব
একটা পাত্তা দিতে লাগল তানা। আমি নাছোড় বান্দা তার পিছে রইলাম। সে একটা রিক্সা
পায়া উইঠা গেল কিন্তু রিক্সাওয়ালা টানলনা আর আমিও লাফ দিয়া রিক্সায় উইঠা গেলাম।
আমি বললাম –এট লিস্ট তোমার নামটা আমাকে বলো। সে ইতস্তত কন্ঠে জানালো তার নাম-শিখা।
শিখা নামটা শোনার সাথে সাথে আমি শক খাইলাম,কারণ আমার আগের গার্লফ্রেন্ডের নাম ছিল
শিখা।আমি লাফ দিয়া রিকশা থিকা নাইমা গেলাম,দেখলাম শিখা অবাক হয়া পেছনে তাকায়
আছে,রিক্সা যাইতে লাগল,রিক্সা মিলা গেল একসময়,আমিও শিখারে হারায় ফেললাম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন