সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দক্ষিণ মৈশুন্ডি কিংবা ভূতের গলিতে আমরা কয়েকজন একা একা মানবেরা (5)


৫। ভাদাইম্যা মিজান

শেফালিকে দূর থেকে দেখে মকবুলের মা , কাছে আসতেই বলে-‘উদলা হয়া গেছিলা কই? মাইয়্যা মানুস ঘোমটা ছাড়া ঘর থন বাইর হয় নিকি?’ শেফালি বিব্রত হয়, ভুলে যায় শাশুড়ির কথা মকবুলের মা বলে উঠে-‘ তোমার চলন বলন আরো ঠিক কর বউ, আমার পোলা সামনের বছর হজ্বে যাইব নিয়ত করছে, হাজ্বি সাবের বিবি তুমি, ঠিক কইছি না!’ শেফালি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয় আসলেই শেফালি তো এখন সাহেরা আপার বান্ধা কাজের মেয়ে না, এই বাড়ির বউ মকবুল এই এলাকার নামিদামি মানুষদের একজন সে প্রথম প্রথম বুঝতে পারে নাই, এখন যখন আসে পাশে যায়, প্রতিবেশিদের সাথে মিশে তখন জানতে পারে সবাই, বিশেষ করে কসাইভিটা,লালবাগ, জিঞ্জিরা এলাকার লোক মকবুলকে কত মান্য করে কসাইভিটার প্রত্যেক ঘরে ঘরে মকবুলের কৃতজ্ঞতার জন্য দোয়া করা হয়, ঘরে ঘরে মকবুলের দেয়া কিছু না কিছু থাকে শেফালি শুনে আর অবাক হয়, নিজেকে ভাগ্যবান ভাবে

আমি ভাদাইম্যা মিজান, সারাদিন টো টো কইরা ঘুরি দেইখা আমার এই নাম পুরা দক্ষিণ মৈশুন্ডি আর ভূতের গলিতে আমারে সবাই চিনে এই নামে আমার এই নামের পেছনে যদিও কোন তাৎপর্য নাই কিন্তু তারপরও লোকে ব্যাখ্যা করে নানা ভাবে আমার বাবার এলাকায় তিরিশ বছরের পুরানা রড সিমেন্টের দোকান, তার পাশের লোহার আলমারি বানানোর কারখানাটাও আমাদের পরিবারের নগদ টাকা আসার সবরকমের রাস্তাই খোলা আমি মৌসুম অনুযায়ী লোকজনকে নিজের নানা রকম উদ্ভাবনী ব্যবসার কথা জানাই যেমন, রমযানের আগে আমি মহল্লার জনে জনে জিজ্ঞাস করি যে তাদের ডাল কিংবা পেয়াজ লাগবে কিনা আমি সাথে এটা যোগ করি যে, এ বছর পেয়াজ বা ডালের দাম অবশ্যই বাড়বে কেননা খবর এসেছে ইন্ডিয়া থেকে সাপ্লাই বন্ধ,বর্ডারে লোকজন ট্রাকসহ ধরা খাচ্ছে কিংবা শীতকালে মানুষ বিভ্রান্ত হয় যখন আমি তাদের বলি নেত্রকোনা থেকে সবজি আনার কথা সবাই শুনে, কেউ কেউ একমত হয়, অনেকেই বিভ্রান্ত হয় আমি কারো কারো চোখের দিকে তাকাই, তারা কতটা বিশ্বাস করে বা বিভ্রান্ত হয় তা বুঝার চেষ্টা করি

লোকমুখে ছড়ায় যে, সাহেরা আপার বাড়িতে মহল্লার লোক আগুন দেয়ার কারণে উনি উনার বোনের বাড়ি কসাইভিটা জামে মসজিদের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন। আর উনার বোনের ছেলের নাম মকবুল। মকবুল খোঁজ নিয়ে জানতে পারে কারা তার খালার বাড়ি পোড়ানোর পেছনের কুশীলব। কেউ কেউ তাকে (মকবুলকে) বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে অথবা তারা ধরেই নেয় যে মকবুল আদতে বের করতে পারবে না এর পেছনের কথা। কিন্তু মকবুল হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পারে। সাহেরা আপা বর্ণনা করে- ‘ সবটি মুখ বাইন্ধ্যা আইছিল, আর কইতাছিল আমি নাকি শেপালিরে বেইচ্যা দিছি!’ মকবুল মুখ গম্ভীর করে থাকে, বুঝার চেষ্টা করে ঠিক কী কারণে এইসব ব্যাপার ঘটতে পারে। কেউ কেউ বলাবলি করে-‘ বহুতদিন শান্তিতে আছিলাম, আৎকা কী হইল এইডা!’ মকবুল শেপালির মুখের দিকে তাকায়, শেফালি হা করে সব শুনতে থাকে। মকবুল অনুমান করে হয়তো শেফালি কিছু জানে, কিংবা কিছুই জানেনা। কারণ ঐদিনই শেফালির সাথে তার বিয়ে হয়। মকবুল লেবুর শরবত খেয়ে এই ঘটনাটি নবম বারের মত শুনে, তারপর ফ্যাক্টরির দিকে রওনা দেয়।

ফ্যাক্টরিতে মকবুল ঝিম মাইরা বসে, ম্যানেজার আইসা কিছুক্ষণ তার মাথা খায়, এই লাগবে সেই লাগবে বইলা অনুমতি নেয়ার চেষ্টা করে। মকবুল খরচের বাহার দেইখা বিরক্ত হয়। মকবুল ভাবে, ঠিক কী কারনে সাহেরা খালার বাড়িতে কেউ আগুন লাগাইতে পারে, তার থিকা বড় তারা শেপালির নাম নিয়া আগুন দিছে। মকবুল দুইয়ে দুইয়ে চার করার চেষ্টা করে। মকবুল ভূতের গলি আর দক্ষিণ মৈশুন্ডির মুরব্বীদের সাথে বসে। বলে-“লালবাগে আমার ফ্যাক্টরি দেওনের আগের কথা কি আপ্নাগো মনে আছে? নাকি মনে করায় দিমু?’ মুরুব্বীরা মাথা চুলকায় কেউ কেউ লুঙ্গির ভেতর হাত ঢুকিয়ে পাছা চুলকায়। তারা মনে করবার চেষ্টা করে মকবুল আসলে কোথা থেকে উঠে এসেছে অথবা মকবুলের উত্থান পর্ব এদের ভালই মনে আছে শুধু সময়ের পরিক্রমায় তারা তা ভুলার পথে। কেউ কেউ মনে করতে পারে, বলে-“আরে বাবা এইডা আমগো তুমি ইয়াদ করায় দিবা নাকি? আমগো সামনেই তো তুমি মকবুল হইলা, আল্লায় দিলে সামনের বছর হজ্ব করবা, বিয়া করছ, ফ্যাক্টরি দিছ, তোমার বদনা আর বানাইন্যা বালতি-মগ আমগো ঘরে ঘরে”। মকবুল হাসে, বলে-“ আমি যে নিজের হাতে আমার বাপরে মারছি তা আপনেরা কেঠা কেঠা এইখানে ইয়াদ করবার পারেন?’’ মুরুব্বীরা আতঙ্কিত বোধ করে কেউবা বিভ্রান্ত হয় এই ভেবে যে মকবুল এই বিশ বছর পর কেন এইসব মনে করিয়ে দিচ্ছে কিংবা সে সামনে কী করতে যাচ্ছে? মকবুল চিৎকার করে উঠে- “আপ্নাগো মহল্লায় আমার খালার ঘরে আগুন দিছে কেঠা? আপ্নেরা যা জানেন সাছ কইরা কইবেন এহন!” মুরুব্বীরা এইবার বুঝতে পারে মকবুল কেন তাদের ডেকেছে। একেক জন একেক কথা বলে, কেউ বলে শেপালিরে তো বেইচ্যা দিছিল তোমার খালা। মকবুল বিরক্ত হয়, বলে-“শেপালিরে বেইচ্যা দিলে আমি নিকা করলাম কেমতে? যেইদিন আগুন দিছে ঐদিন আমগো নিকা আছিল না!” মুরুব্বীরা আবারো আকাশ থেকে পড়ে, এইবার সবাই বিভ্রান্ত হয়। আসলেই তো ঠিক কী কারণে তাহলে সাহেরা আপার বাড়িতে আগুন লাগল? মুরুব্বীদের গুঞ্জন থেকে মকবুল তাদের ধরিয়ে দেয় এইখানে ভাদাইম্যা মিজানের হাত আছে। -“ ঐ মাঙ্গের পোলারে কইবেন আমার এইখানে আয়া হাজিরা দিয়া যাইতে, হমুন্দির পুত যত বাপের পোলাই হউক না ক্যান ওরে কইবেন হাজিরা দিতে আইতে’’। মুরুব্বীরা হাফ ছেঁড়ে বাঁচে, তারা যত তাড়াতাড়ি পারে মকবুলের ফ্যাক্টরি থেকে পালায়।

মকবুল আমার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকায় থাকে। আমি মকবুলের ফ্যাক্টরিতে হাজিরা দিতে আসছি, এই সেই মকবুল যে বদনা-বুদনা বানায় , শেপালির কথা জিগাইতে মন চায়াও জিগাই না, থাক সে এখন পরস্ত্রী। মকবুল জিজ্ঞাস করে-‘ চা খাইবা?’
-“না , ডাকছেন কেলা, কন দিহি’’
-“তুমি আমার একটা কাম কইরা দিবার পারবা?’’
আমি অবাক হই, এই প্রথম কেউ আমারে একটা কাজ কইরা দেয়ার কথা কইতাছে। অন্য সময় তো আমি মানুষরে খুঁইজা বেড়াই যে কার কী কাজ কইরা দিতে হইব, কিংবা কারো কোন ফরমায়েশ আছে কিনা, সবাই আমারে এড়ায় চলে। আর এইবার সরাসরি মকবুলের মত লোক আমারে কাজ করার হুকুম দিতাছে।
-‘কী কাম কইলেন নাতো!’
- কী কাম ! সেইটা তুমি খুঁইজা বাইর করবা মাঙ্গের পোলা, মকবুল কোমর থেকে পিস্তল বাইর করে, মকবুলের পেছনে দাঁড়ানো আসলাম কসাই চোখ গরম করে তাকায়, আমার ঘাড়ে দুই আঙুল দিয়ে চাপ দেয়। আমি কোঁকায় উঠি, আল্লাগো বইলা চিৎকার দেই। মকবুল হিশ হিশ করে, পিস্তলের নল আমার মুখে ঢুকায়, পিস্তলের ঠান্ডা নলের নোনা লোহার স্বাদ আমার পিঠে ঠান্ডা স্রোত নামায় আনে। মকবুল পিস্তলের নল বাইর করে। বলে-“ তোরে একটা কাম দিছি, এইডা তুই-ই বাইর করবি আমি তোরে কী কাম দিছি , না করবার পারলে কসাই তুই ওরে বুটি বুটি কইরা বিরানি রাইন্ধ্যা ওর বাপরে খাওয়ায় দিবি”।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নিমাইকে ঘিরে কিছু প্রশ্ন

সময়টা তখনও দুপুর হয়নি,কৃষক নিমাইকে উষ্কখুষ্ক অবস্থায় মাঠে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কেউ হয়তো তাকে খেয়াল করছে, কেউ হয়তো করছে না। নিমাইয়ের পাশের ক্ষেতে চাষীরা কাজ করছে। এমন কর্মব্যস্ত দিনে নিমাইকে গালে হাত দিয়ে আকাশ পানে চেয়ে থাকতে দেখে কারো মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে, কারো হয়তো জাগছে না। পাশের ক্ষেতগুলোতে   কাজ করছে ভূমিহীন বর্গাচাষী ইদ্রিছ মিয়া,দীর্ঘদেহী সোলায়মান আর প্রাণেশ। তারা কেউ কেউ নিমাইয়ের কুশল জিজ্ঞাসা করে, কেউ করেনা।  নিমাই একজন বর্গাচাষী এবং অবশ্যই অস্বচ্ছল। অভাব অনটন যে তার এবং তার জাতের নিত্যসঙ্গী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্গাচাষীদের নিজের জমি থাকে না,অন্যের জমিতে তারা চাষ করে বিনিময়ে অর্ধেক অথবা তিন ভাগের এক ভাগ ফসল পায় এবং তা দিয়ে তাদের সারা বছরের অভাব কোনক্রমেই ঘুচে না। তাদের বছর বছর বংশ বৃদ্ধি পায়, প্রবীন একজনের হয়তো মৃত্যু হয়,যুবক আর কিশোরীদের বিয়ে হয়,যুবতী বোন হয়তো স্বামী পরিত্যাক্তা হয় কিন্তু তিন অক্ষরের অভাবটাই ঘুচে না।   নিমাইয়ের ঘরে স্বাভাবিকভাবেই হোক অথবা বাধ্য হয়েই হোক এক বউ। মুসলমান হলেও সে দুই অথবা তিন বউ রাখতে পারত না। এর জন্য আর্থিক সঙ্গতি...

দক্ষিণ মৈশুন্দি কিংবা ভূতের গলিতে মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে (2)

                          পর্ব ২- শেপালি মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে আমার কিংবা আমাদের পরিচয়ের প্রথম পর্বে শেফালির বিয়ে হয়ে যায়। আবার আমাদের সিদ্ধান্তেও আশা যাবেনা যে শেফালির বিয়ে হয়েছে , ওর তো বিয়ে হবার কথা ছিল, বিয়ে হয়েছিল কিনা সেটা আমরা এই গল্পের শেষে জানতে পারব , হয়তোবা পারবনা। আমরা কেউ শেফালির গ্রামের বাড়ির ঠিকানা না জানাতে ওর বিয়েতে উপস্থিত হতে পারিনি ব্যাপারটা আসলে এমন নয়, শেফালি কিংবা শেফালির বাবা আমাদের কাউকেই বলে যায়নি অথবা বিয়ের দাওয়াত আমরা পাইনি।  ভেজা হাত ধরতে ধরতে হঠাৎ একদিন আর জানালা খুলতে না পেরে আমি বুঝতে পারলাম হয়তো খুব ভোরেই শেফালি বাড়ি ছেড়েছে,শুধু জানতে পাইনি কিংবা জানতে পেরেও আমি পরেরদিন আমার নির্ধারিত সময়ে জানালায় হাত দেয়ার পরক্ষণেই এলাকার দোকানদার মন্ডল জানালো -'শেপালি তো গেছেগা, আন্ধার কাটোনের আগ দিয়াই গেছেগা'। আমি আগে থেকে জানতাম এমন ভাব করে বললাম-'হ, কইতাছিল যাইবগা, অর বাপে নিহি আইছিল, বুইড়া কইছে ওরে যেন না বিছড়াই'। মন্ডল আমার কথা বিশ্বাস করলো কী করলো না তার অপেক্ষায় না থেকে আমি পা বা...

ট্রলার

পান চিবাইতে চিবাইতে আব্দুর রহমান বাড়ি ফিরে। দুপুরে খাবারের পর সে নিয়ম করে ঘর থেকে বাইর হয়, তা যতই বৃষ্টি হোক কিংবা ঠাডা পড়া রোদই হোক না কেন, রশিদের দোকান থেকে সে পান কিনে, হালকা জর্দা দেয়া, একটু চুন সাথে সুপারি দেয়া অর্ধেক পান খাবে সে এবং শেষ পিকটা ফেলবে সে তার বাড়ির দরজার পাশের দেয়ালে আর এভাবেই ঐ দেয়ালটার নিচের সম্পূর্ণ অংশ সবসময় লাল হয়ে থাকে। আব্দুর রহমান চল্লিশোর্ধ্ব, কোন কারনে সে এলাকায় গরুর ব্যাপারী হিসেবে পরিচিত, তাকে সবাই আব্দুর রহমান বেপারী ডাকে, তবে লোকে তাকে কেন গরুর ব্যাপারী ভাবে সে আজো ঠাওর করতে পারেনা, কোনদিন ঘোর লাগা এক বর্ষার রাতে সে কলিমুদ্দি ব্যাপারীর সাথে তাস খেলতে খেলতে হয়তো গরুর বেপার নিয়ে দুই একটা কথা বলছিল তাতেই কি লোক তাকে ব্যাপারী নাম দিল নাকি তা নিয়ে সে প্রায়ই ভাবে এবং ভাবতে ভাবতে কোন কুল কিনারা না করতে পেরে মাছের ট্রলার আজো কেন ফিরল না সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। আব্দুর রহমানের আসল কাজ মিয়া বাড়ির আটটা ট্রলার দেখা শোনা করা, এবং এই এলাকায় যে আর কারো দুই একটার বেশি ট্রলার সে বাড়তে দেয়না এইটা জানার কারণে মিয়া বাড়ির বড় মিয়া তাকে বেশ স্নেহ করে আর এই স্নেহ মাঝে মধ্যে বাড়...