সময়টা তখনও দুপুর হয়নি,কৃষক
নিমাইকে উষ্কখুষ্ক অবস্থায় মাঠে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কেউ হয়তো তাকে খেয়াল করছে,
কেউ হয়তো করছে না। নিমাইয়ের পাশের ক্ষেতে চাষীরা কাজ করছে। এমন কর্মব্যস্ত দিনে
নিমাইকে গালে হাত দিয়ে আকাশ পানে চেয়ে থাকতে দেখে কারো মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে,
কারো হয়তো জাগছে না। পাশের ক্ষেতগুলোতে
কাজ করছে ভূমিহীন বর্গাচাষী ইদ্রিছ মিয়া,দীর্ঘদেহী সোলায়মান আর প্রাণেশ।
তারা কেউ কেউ নিমাইয়ের কুশল জিজ্ঞাসা করে, কেউ করেনা।
নিমাই একজন বর্গাচাষী এবং
অবশ্যই অস্বচ্ছল। অভাব অনটন যে তার এবং তার জাতের নিত্যসঙ্গী তা আর বলার অপেক্ষা
রাখে না। বর্গাচাষীদের নিজের জমি থাকে না,অন্যের জমিতে তারা চাষ করে বিনিময়ে
অর্ধেক অথবা তিন ভাগের এক ভাগ ফসল পায় এবং তা দিয়ে তাদের সারা বছরের অভাব
কোনক্রমেই ঘুচে না। তাদের বছর বছর বংশ বৃদ্ধি পায়, প্রবীন একজনের হয়তো মৃত্যু
হয়,যুবক আর কিশোরীদের বিয়ে হয়,যুবতী বোন হয়তো স্বামী পরিত্যাক্তা হয় কিন্তু তিন
অক্ষরের অভাবটাই ঘুচে না।
নিমাইয়ের ঘরে স্বাভাবিকভাবেই
হোক অথবা বাধ্য হয়েই হোক এক বউ। মুসলমান হলেও সে দুই অথবা তিন বউ রাখতে পারত না।
এর জন্য আর্থিক সঙ্গতি তো লাগেই শারীরিক সঙ্গতি না থাকলেও বউ পালা যায় না।
নিমাইয়ের দ্বিতীয়টা থাকলেও প্রথমটা তার জাত গোষ্ঠীর কারোরই নেই। নিমাইয়ের যে
বহুগামীতায় অরুচি নেই,কিন্তু মালের সাথে কড়িও তো থাকতে হবে। এছাড়া নিমাইয়ের ঘরে
মা,ছোট বোন তো আছেই। কোনদিন আবার বড় বোনটা বিধবা হয়ে অথবা স্বামী পরিত্যাক্ত হয়ে
ফিরে আসে তাও কী নিমাই ভাবছে?
নিমাইকে মাঠে বা ক্ষেতে গালে
হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে চাষীদের কেউ কেউ হয়তো ভাবে তার বউয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে।
কেউ হয়তো ভাবে নিমাইয়ের অসুখ করেছে কিংবা গা টা একটু ম্যাজম্যাজ করছে। আসলে
নিমাইয়ের কী হয়েছে তা কেউ জানে না, হয়তো কেউ কেউ কিংবা সবাই আন্দাজ করতে পারছে।
নিমাই কী আসলে তখন আকাশ দেখছিল নাকি মেঘহীন আকাশে তখন সে স্বপ্ন বুনছিল? নাকি
প্রতিনিয়ত যুদ্ধের পূর্বে সে যে প্রস্তুতি নেয় সেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল? নাকি সে
ক্রমাগত বিধাতাকে জিজ্ঞেস করছিল কবে সে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারবে? এরকম অনেক
প্রশ্ন আমাদের আর চাষীদের দরজায় কড়া নাড়ে।
নিমাই সকালে ভরপেট খেতে পারেনি।
রুচি হচ্ছিল না বলে নয় কিংবা তাই-ই হতে পারে। অথবা নিমাইয়ের ঘরে চাল,মুড়ি,চিড়া
কোনটাই ছিল না। নিমাইয়ের বউয়ের নাম সীতা।
ছোটবেলায় রামায়ন শুনে শুনে নিমাইয়ের চোখে ভাসত যে সীতা ঠিক সেরকমই মায়াবী দেখতে
তার সীতা। নদীর জলের মতো স্বচ্ছ চোখ, সারা শরীরে যেন ঢেউ বয়ে যায়,কোমল ঘাড় আর
বাহু,পীনোন্নত বুক,বড় নাভিমূল,কমলার কোয়ার মত ঠোট যুগলে হাসি লেগেই থাকে সারাক্ষণ।
নিমাই কী এখন বসে বসে সীতার কথাই ভাবছে? নাকি মালতীর কথা? মালতী নিমাইয়ের পিসতুতো
বোন। বিয়ের আগে সে মালতীর দিকে তাকাতোই না। কিন্তু যেই মালতীর বিয়ে হয়ে গেল সেই
কিশোরী বয়সে তারপর থেকেই নিমাই নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগল। নিমাই তখনো বিয়ে করেনি ,
বিয়ের মত বয়স অবশ্য হয়নি কিন্তু নারীদেহ চিনতে পারার মত বয়স তার হয়েছিল। বিয়ের পর
মালতী বাপের বাড়ি আসত যখন তখন নিমাই খেয়াল করত মালতীকে খুব গভীর ভাবে। প্রতিদিনই
যেন মালতীর রূপ বাড়ছে। তার প্রায় অদৃশ্য স্তন দুটি হয়ে যাচ্ছে ডাবের মত যা কয়েকদিন
আগেও ছিল বাতাবি লেবু। হয়তো নিমাই এসবের কিছুই ভাবছে না।
নিমাইয়ের গলায় গামছা,পরনে জীর্ণ
একটা লুঙ্গী। মাঠে কাজ করার সময় সে কিছু গায়ে দেয় না কিন্তু
নিমাই তো আজ কোন কাজই করছে না। নিমাই কী ভাবছে তার পুরোনো বন্ধু মিহির মাঝির কথা?
মিহির মাঝি গেল বার গাঙে ডুবে মারা গেল তখন নিমাই কী কান্নাটাই না কাঁদল ! অথচ
মিহির সাঁতার জানত সবার থেকে ভাল। ছোটবেলা থেকেই নদীতে সাঁতার কাটত। নাকি নিমাই
তার বড় মেয়ে শ্যামার কথা ভাবছে যে কিনা এখন সাতে পড়েছে? এতটুকুন মেয়ে অথচ কী
সুন্দর চুল ! এতো বড় চুলগুলোকে যখন ও খোপা করে তখন নিমাইয়ের চোখে মায়ের মুখটা ভেসে
ওঠে, সে একবার মাকে দেখে আরেকবার মেয়েকে। বয়সের ব্যবধান কত ! অথচ চেহারায় কত মিল !
নিমাই আর সীতার যেবার বিয়ে
হয়েছিল সেবার প্রচন্ড শীত পড়েছিল । ফুলশয্যার রাতে সীতা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল।
নিমাই যেই কুপিটা একটু কমাল সেই সীতার ঠকঠকানি আরো বেড়ে গেল। নিমাই সীতাকে জড়িয়ে
ধরে বলল- বউ কাপিসনে,আমি তোকে কামড়াব না। নিমাই কী এখন একটু হাসছে? হয়তো নিমাই
এটাও ভাবছে না। আশে পাশের বর্গাচাষীদের কেউ কী খেয়াল করে নিমাই ঘামছে,দরদর করে
ঘামছে? হয়তো কেউই খেয়াল করে না। নাকি নিমাই ভাবছে গতরাতের কথা যখন নিমাইয়ের কানে
কানে ঘর্মাক্ত ও তৃপ্ত সীতা বলেছিল – আরেকডা ছাওয়াল আইসছে পেটে। নিমাই কী তাই
ভাবছে? হয়তো হ্যাঁ অথবা না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন