সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দক্ষিণ মৈশুন্দি কিংবা ভূতের গলিতে মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে (2)

                          পর্ব ২- শেপালি


মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে আমার কিংবা আমাদের পরিচয়ের প্রথম পর্বে শেফালির বিয়ে হয়ে যায়। আবার আমাদের সিদ্ধান্তেও আশা যাবেনা যে শেফালির বিয়ে হয়েছে , ওর তো বিয়ে হবার কথা ছিল, বিয়ে হয়েছিল কিনা সেটা আমরা এই গল্পের শেষে জানতে পারব , হয়তোবা পারবনা। আমরা কেউ শেফালির গ্রামের বাড়ির ঠিকানা না জানাতে ওর বিয়েতে উপস্থিত হতে পারিনি ব্যাপারটা আসলে এমন নয়, শেফালি কিংবা শেফালির বাবা আমাদের কাউকেই বলে যায়নি অথবা বিয়ের দাওয়াত আমরা পাইনি।  ভেজা হাত ধরতে ধরতে হঠাৎ একদিন আর জানালা খুলতে না পেরে আমি বুঝতে পারলাম হয়তো খুব ভোরেই শেফালি বাড়ি ছেড়েছে,শুধু জানতে পাইনি কিংবা জানতে পেরেও আমি পরেরদিন আমার নির্ধারিত সময়ে জানালায় হাত দেয়ার পরক্ষণেই এলাকার দোকানদার মন্ডল জানালো -'শেপালি তো গেছেগা, আন্ধার কাটোনের আগ দিয়াই গেছেগা'। আমি আগে থেকে জানতাম এমন ভাব করে বললাম-'হ, কইতাছিল যাইবগা, অর বাপে নিহি আইছিল, বুইড়া কইছে ওরে যেন না বিছড়াই'। মন্ডল আমার কথা বিশ্বাস করলো কী করলো না তার অপেক্ষায় না থেকে আমি পা বাড়ালাম। 

যথারীতি পুরির দোকানদার আজমলের  দোকানে আমি মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবকে দেখতে পারলাম পুরির সাথে শসা খাচ্ছেন। আমি আজমলকে চা দিতে বলে খালি বাতাসে কথা ছোড়ার মত বললাম-' হুনলাম শেফালিরে নাকি সাহেরা আপা বেইচ্চ্যা দিছে?' - 'আবে হালায়, কী কইবার লাগছচ, ওরে তো ওর বাপে লয়া গেছে' , আজমল লাফ দিয়ে ওঠে, চিৎকার করে বলে- 'আমরা তো জানি ওর নাকি বিয়া ঠিক হইছে' । সবাই এদিক সেদিক তাকায়, মোহাম্মদ শহীদুল হক সাব পুরি শেষ করে চায়ের অর্ডার দেয়। আমার কথায় উঁনার অভিব্যক্তি দোকানে কারোরই ধরা পড়েনা কিংবা কেউই এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উঁনার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেনা।  আমি বলে উঠি -'না, ওরে সাহেরা আপা ইন্ডিয়ায় বেইচ্যা দিছে'। অত্যন্ত জোরালো গলায় বলার কারণেই হোক কিংবা বক্তব্যের গুরুত্বের কারণেই হোক; এই কথায় সবাই সবার দিকে তাকায়, কেউ কেউ কারো হাতের চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে যায়, কারো শেষ হয়ে আসা সিগারেট ফিল্টারের তাপ বাড়িয়ে দুই আঙ্গুলের চিপায় বন্ধ হয়ে যায় । সবাই বিভ্রান্ত হয়, কিংবা কেউ কেউ হয়না , হয়তো কেউই হয়না। বাতাসে প্রতিধ্বণিত হয়-'সাহেরা আপা এইটা একটা কাম করলো নিকি! ওর তো বিয়া হয়া যাওনের কথা'। কেউ কেউ বলে উঠে- ' লও পুলিসে খবর দেই'। - 'আবে হালায়, পুলিসে করব কী, ট্যাকা খায়া ছাইড়া দিব'। আমি প্রস্তাব দেই- ' চলেন আমরা সাহেরা আপার বাইত্তে আগুন লাগায় দেই, হ্যাগো একটা শিক্ষা হউন দরকার, নারী পাচার করার মজা বুঝায় দিমু'। কেউ কেউ এই প্রস্তাবে অতি উৎসাহ বোধ করে, বহু বছর এই দক্ষিণ মৈশুন্দি আর ভূতের গলিতে আগুন লাগেনা, কোন রকম গ্যাঞ্জাম ছাড়াই এত বছর কাটানো কিভাবে সম্ভব হয়েছে তা ভেবে অনেকে হতাশা বোধ করে। অনেকের মনে ক্ষোভ জাগে, আজমলের চুলা থেকে জ্বলন্ত লাকড়ি উঠায়, সাত-আটজনের একটা দল রওনা দেয় সন্ধ্যার আজানের পর পরই, আমি এই ভিড়ের মধ্যে মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবরে দেখতে পাইনা, তিনি বোধ হয় সিগারেট টানতে টানতে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন। 

এলাকায় ফায়ার ব্রিগেড আর পুলিশ আসে, মন্ডলের দোকান বন্ধ দেখা যায়, আতঙ্কে সব দোকান বন্ধ, লোকজন বাড়ির জানালা-দরজা বন্ধ করে ভেতরে দোয়া-দরুদ পড়তে থাকে। 


দূরের কালো ধোঁয়ার সাথে দক্ষিণ মৈশুন্ডি আর ভূতের গলির বাসিন্দাদের দীর্ঘশ্বাস আকাশে মিশে যায়,কারো কারো হয়তো বোধদয় হয় এই শান্ত জীবনে এইটা ছিল একটা আকস্মিক ঝড়,যেমনটা হয়ে থাকে বৈশাখের শুরুতে। বুড়ো লোকেরা পশ্চাৎ চুল্কাতে চুল্কাতে ভাবে এটা হয়তো তাদের একঘেয়েমি যে জীবন যাপন তাতে একটা আমূল বৈচিত্র্য এনে দিতে পারে। চায়ের কাপে পরদিন হয়তো তুমুল ঝড় উঠবে, কেউ কেউ এটাকে সমাজের শ্রেনী বৈষম্যের বিপক্ষে,শাসকের প্রতি শোষিতের তুমুল চপেটাঘাত,মার্ক্স-এঙ্গেলস কিংবা নক্সালের একটা ডিস্কোর্স হিসেবে ব্যাখ্যা করতে উঠে পড়ে লাগবে না তা আমরা এখনই নিশ্চিত হতে পারিনা। 

আমাদের এই নিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তার মাঝেই মোহাম্মদ শহীদুল হক সাব খুব ভোরে উঠে একটা বাংলা ফাইভ ধরাবেন কিংবা ধরাবেন না, আজমলের পুরির দোকান খুলবে কি খুলবে না তা খুব প্রকট হয়ে উঠবে। 

(চলবে)





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বেদখল

আমাগো বাড়ি দখল হয়া গেছে, আমগো বাড়ির চারপাশে এখন বাউন্ডারি বয়া গেছে। আমগো কইছিল হুমুন্দির পুত-'বাড়ি ছাড় নইলে লাস ফালায় দিমু' আমরা ক্যাচাল করি নাইকা, আমরা কইছিলাম- সময় দেন, আপসেই সইড়া যামু। আমগো সময় দেই নাইকা, আমরা আসমানের নিচে হুই, আমগো কেউ কয় আমরা ছিন্নমূল, কেউ কয় আবে বস্তিত গিয়া থাক,ঐ। আমরা মাথা নাড়াই, ভেজালের কারবার করিনা, আমার পোলা স্মাগলার, নইলে কিলার-শ্যুটার হইব, ভয় পায়না। আমগো বাড়ি দখল কইরা দেন, আমি আপনার শত্রুরে মাইরা দিমু, আমগো পোলাপাইন পড়া লেহা করব, ওগো মানুস বানামু।

দৃষ্টি এবং ইচ্ছের দেবতার প্রতি প্রশ্ন

যখন দৃষ্টি সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর যেতে চায় তখন কেন জানি আচমকা চোখ ফিরিয়ে নেই। আমার দৃষ্টি কী ক্ষীণ? আমার দৃষ্টি কী ভীরূ? নাকি আমার ইচ্ছের দেবতা আমার দৃষ্টিকে আর যেতে দেয় না? ইচ্ছের দেবতা কী আর সাহস পায় না? প্রগাঢ় লজ্জায় দেবতা আমায় বলে “দৃষ্টিরও একটা সীমা মানতে হয়,কখনোই দৃষ্টিকে সীমাহীন হতে দেব না”। এই দেবতার নাম নাকি ইচ্ছে দেবতা! সমাজের সুশীল সমাজের বাইরের মানুষরা তাই গালি দেয়- উদ্দেশ্য এই ‘ইচ্ছে দেবতা’,আর সুশীলরা দার্শনিক তত্ত্ব প্রকাশ করেন! ইচ্ছের দেবতা কে আমার প্রশ্ন-“ তোমায় দেবতা বানালো কে?আমি না আমরা? নাকি মহামতি ঈশ্বর? নাকি আমাদের সমাজ তোমায় পঙ্গু করলো”?

ট্রলার

পান চিবাইতে চিবাইতে আব্দুর রহমান বাড়ি ফিরে। দুপুরে খাবারের পর সে নিয়ম করে ঘর থেকে বাইর হয়, তা যতই বৃষ্টি হোক কিংবা ঠাডা পড়া রোদই হোক না কেন, রশিদের দোকান থেকে সে পান কিনে, হালকা জর্দা দেয়া, একটু চুন সাথে সুপারি দেয়া অর্ধেক পান খাবে সে এবং শেষ পিকটা ফেলবে সে তার বাড়ির দরজার পাশের দেয়ালে আর এভাবেই ঐ দেয়ালটার নিচের সম্পূর্ণ অংশ সবসময় লাল হয়ে থাকে। আব্দুর রহমান চল্লিশোর্ধ্ব, কোন কারনে সে এলাকায় গরুর ব্যাপারী হিসেবে পরিচিত, তাকে সবাই আব্দুর রহমান বেপারী ডাকে, তবে লোকে তাকে কেন গরুর ব্যাপারী ভাবে সে আজো ঠাওর করতে পারেনা, কোনদিন ঘোর লাগা এক বর্ষার রাতে সে কলিমুদ্দি ব্যাপারীর সাথে তাস খেলতে খেলতে হয়তো গরুর বেপার নিয়ে দুই একটা কথা বলছিল তাতেই কি লোক তাকে ব্যাপারী নাম দিল নাকি তা নিয়ে সে প্রায়ই ভাবে এবং ভাবতে ভাবতে কোন কুল কিনারা না করতে পেরে মাছের ট্রলার আজো কেন ফিরল না সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। আব্দুর রহমানের আসল কাজ মিয়া বাড়ির আটটা ট্রলার দেখা শোনা করা, এবং এই এলাকায় যে আর কারো দুই একটার বেশি ট্রলার সে বাড়তে দেয়না এইটা জানার কারণে মিয়া বাড়ির বড় মিয়া তাকে বেশ স্নেহ করে আর এই স্নেহ মাঝে মধ্যে বাড়...