সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইন্দুর বিলাইয়ের গল্প


লেখালেখিকে যতটা সহজ ভাবা হয় আসলে তা ততো সহজ নয়। রাইটার্স ব্লক কয়েক দিন, কয়েক মাস , এমনকি কয়েক বছরও যেতে পারে। আবার এমনো হতে পারে এই জীবনে আর লেখা হবে না। ঠিক তেমনটাই হয়েছিল আজিজুল রহীমের সাথে। আমাদের জানামতে আজিজুল রহীম তার ডায়েরীতে সর্বশেষ লিখেছিলেন ১৯৯৭ এ। তখন তার বয়স বত্রিশ। সবে একটি নতুন চাকরিতে প্রবেশ করেছেন কয়েক বছরের পুরোনো পত্রিকা অফিস রেখে। একটি মাঝারি মানের প্রেসের ব্যবস্থাপক হিসেবে। সাড়ে চার বছরের অনিয়মতান্ত্রিক চাকরি ছেড়ে ৯-টা অফিস আর শুক্রবার বন্ধ। এ যেন এক বন্দীশালা। তবুও ঠিকঠাক চলছিল ব্যস্তজীবন আর সংসারের চাপে একটা আলাদিনের জ্বীন ভর করেছিল আজিজুল রহীমের কাঁধে। 


আজিজুল রহীম তাঁর এনায়েতগঞ্জের বাসা ছেড়ে উঠেন সেগুনবাগিচায়। নতুন বাসাতে ওঠার পর থেকেই নতুন কিছু উৎপাত শুরু হতে থাকে। এক নম্বর সমস্যা হল ইঁদুর। এবং এই ইঁদুরগুলো সম্ভবত এনায়েতগঞ্জের সেই পুরোনো বাসারই পুরোনো সঙ্গী। আজিজুল রহীম রাত বারটায় যখনই শোয়ার জন্য মশারীর ভেতর ঢুকেন তখনই ইঁদুরগুলা তাঁর তোষক আর খাটের তল দিয়া নড়াচড়া করতে শুরু করে। আর এতে আজিজুল রহীম সাহেবের ঘুমাতে ঘুমাতে রাত তিনটা-চারটা বাজে। এই সমস্যাটাও সমস্যা না যদিনা আজিজুল রহীম সাহেব ইঁদুরদের কথা বার্তা না শুনতেন এবং এইটা হল সমস্যা দুই। 


ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়া আজিজুল রহীম সাহেব তাঁর নতুন যোগ দেয়া মাঝারি মানের প্রেসে যান। গিয়া দেখেন পিওন তাঁর জন্য চা নিয়া আসছেন এবং এই একটা মাত্র ব্যাপারই তাকে পুরোদিনে আমোদিত করে। বত্রিশ বছরের আজিজুল রহীম সাহেব প্রেসের উপর নিচ করেন, এর ওর সাথে রাগারাগি করেন এবং বেলা পাঁচটার মধ্যে ক্লান্ত বোধ করেন, এর মধ্যে তিনি দশবারের মত চা পান করে ফেলেন। কখনো কখনো রাত জেগে প্রেসের কাজ দেখাশোনা করতে হয় উনার যদি পরের দিন ডেলিভারী থাকেো। কাস্টমারের মন মত কাজ না করলে ব্যবসা লসে যাবে সেটা লেখক এই ব্যবস্থাপক ভালই বুঝেন। আজিজুল রহীম সাহেব ক্লান্ত মনে কাজ করেন, বাড়িতে গিয়ে ইঁদুরের গল্প শুনেন। এই রকম চললে তো ভালই হত কিন্তু এর মধ্যে আবার নতুন বিপদ ঘনায় আসে। 


আজিজুল রহীমের এর মধ্যে প্রচন্ড জ্বর হয় এবং জ্বরে পাগলের মত বিড়বিড় করতে করতে উস্কখুস্ক চুল দাড়ি নিয়া তিনি হাজির হন পাশের মেডিকেল সেন্টারে, সেখানে হাফিজউদ্দীন ডাক্তার তাকে রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা দেয়, ডাক্তার সাহেব জানান বাড়িতে ইদুর থাকলে তাঁর সংক্রমনে জ্বর আসতে পারে, ইদুর তাড়ানোই হবে আসল সমাধান। আজিজুল রহীম সাহেব বাড়িতে গিয়ে চারপাশে ইদুরের ঔষধ দেন, খাবারে বিষ মেশান। এরপর ধীরে ধীরে টয়লেটে গিয়ে শেভ করেন, গোসল করেন, কাপড় বদলান আর একটা ব্যাগে কিছু কাপড়, পড়ার বই নিয়ে প্রেসে চলে যান। প্রেসে আজিজুল রহীমের সাথে দেখা হয় প্রেস মালিক মিল্লাত হাজীর সাথে। মিল্লাত হাজী সাহেব আজিজুল রহীমের লাল চোখ দেখে তাকে বাড়িতে গিয়ে ছুটি কাটাতে বলেন। সাথে সাথে এও বলেন- এইবার একটা শাদী কইরা ফালান ম্যানেজার, আর কত একলা জিন্দেগী পার করবেন? আপনার উমরে আমার তিন মাইয়া আর দুই পোলার সংসার, সবার বিয়া দিয়া ফালাইছে, হজ্ব কইরা আল্লা বিল্লা করি, শাদি করেন, জ্বর মুর আর আইব নাএইসব বলে মিল্লাত হাজ্বী সাব মুচকি মুচকি হাসেন, ম্যানেজারের জন্য কচি ডাব আনান। ডাব খেয়ে আজিজুল রহীম সাহেব তাঁর পৈত্রিক বাড়ি কসাই ভিটাতে রওনা দেন। 



আজিজুল রহীমকে অনেকদিন পর তাঁর মা দেখে প্রথমে কেঁদে উঠেন , তারপর মিনিট দশেক বাদে শান্ত হয়ে ভেজা পিঠা খেতে দেন। বলে উঠেন- আমার মন কইতাছিল তুই আইবি, নাইলে কোন দুঃখে আমি ভিজা পিঠা বানাই !আজিজুল রহীম জ্বর মুখে খেতে পারে না, তাঁর মা তাকে বাতাসী মাছের ঝোল নরম ভাতের সাথে মাখিয়ে খেতে দেয়। চার ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে এই ছেলে সবচেয়ে ছোট আর সবচেয়ে ভাবালু। কোনদিন কারো আগেও ছিলনা, পরেও না। এমনকি বাড়িতে এই ছেলের জন্য কোনদিন কোন বিচারও আসেনি।


সকালে ঘুম থেকে উঠে আজিজুল রহীম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তাঁর মা তাকে বলে - আব্বা, তোমার জ্বর আইচে কও নাই ক্যালা, কী খাইবার মন চায় বাবা, কও বানায় দিই, পিঠা খাইবা, ভাপা পিঠা বানায় দিই?’ আজিজুল রহীম বিছানায় উঠে বসে, মাথা নাড়ে, মানে সে পিঠা খেতে চায়। কসাই ভিটা জামে মসজিদের ইমাম আজিজুল রহীমের বাবা, তাঁর দাদার জমিতে বাবা যখন মসজিদ বানায় তখন আশে পাশে কোন পাকা মসজিদ ছিল না, সেই হিসেবে কসাইভিটা জামে মসজিদ অত্র এলাকার প্রথম পাকা মসজিদ। এখন এইখানে দিনে আর বিকেলে বাচ্চাদের কুরআন শেখানো হয়। আজিজুল রহীম জ্বর শরীরে মসজিদে যায়, বাবার সাথে দেখা হয় তাঁর। 


বাবা শফিকুল রহীম জিজ্ঞাস করলেন- তোমার মায়ে কইল তোমার নিকি বুখার আইছে, গা গরম লয়া ঢাকাত থন আইছ ক্যালা, আর আইছই যখন তহন আবার বাইর হইচ ক্যালা?’ আজিজুল রহীম তাঁর বাবাকে সেগুনবাগিচার ইদুরের কথা বলে, এও বলে যে এগুলা সব এনায়েতগঞ্জ থেকে তাঁর সাথে আসছে, এবং সে ইদুরদের সব কথপোকথন শুনতে পায়। শফিকুল রহীম ছেলে উপদেশ দেন বাড়িতে সাদা ইন্দুর পালতে অথবা বিড়াল পালতে-
দেখ বাবা বিলাই পালা নবিজীর সুন্নত, নবিজি বিলাইয়ের লাইগা আপনা চাদর কাইটা ফেলছিলেন, বিলাই পাল, আর নামায পড়, আল্লার নাম লও, ইন্দুরের কথা হুন, মাইষে হুনলে কইব কী? আমি তোমার বিয়ার এন্তেজাম করতাছি তাঁর আগে বিলাই পাঠায়া তোমার বাড়ির ইন্দুর মারতে হইব 


আজিজুল রহীম সেগুনবাগিচায় ফিরে, গিয়ে দেখে বহাল তবিয়তে সেখানে দেখে ইদুরের দল খেলা করছে, রান্নাঘরে দৌড়াদৌড়ি করছে। সে শুনতে পায় ইদুরগুলা হাসাহাসি করছে, সে যে একটা আহাম্মক এইটা ইদুরের দলপ্রধান বাকি ইদুরদের বলতে থাকে। ভেজাল বিষের শোকে আর ইদুরদের বাহাদুরি দেখে আজিজুল রহীম ক্রোধে উন্মাদ হয়। পরদিন কসাইভিটার বাড়িতে খবর পাঠায় বিড়ালের জন্য। একটা হুলো বিড়াল আর একটা মেনি বিড়াল আসে ইদুর মারার জন্য। আজিজুল রহীম মশারির ভেতর থেকে শুনতে পায় ইদুরদের আহাজারি, আতঙ্কগ্রস্থ চিৎকার, ছুটোছুটি। ইদুরদের সর্দার সবাইকে গর্তে লুকাতে বলে। কিন্তু সবার আগে হুলো বিড়ালটা তাকেই ধরে। এবং আজিজুল রহীম দরজা খুলেই রাখে যাতে বিড়ালগুলো আরাম করে ঘরে-বাইরে করতে পারে। সকাল বেলা আজিজুল রহীম ঘুম থেকে উঠে দেখলেন বাড়ির সব ইদুর মরে সাফ, আর বিড়ালগুলা চোখ বন্ধ করে রোদ পোহাচ্ছে বাইরে। 


আজিজুল রহীম কসাইভিটার বাড়িতে খবর পাঠায় যে, তার ঢাকার বাড়ির সব ইদুর মরে সাফ। আজিজুল রহীম খুশি মনে বিড়ালদের দুধ খেতে দেয়, বিড়ালদুটো খুশিমনে তার আদর নেয়, চোখ বন্ধ করে মাটিতে গড়াগড়ি করে, উপর হয়ে শোয়, আজিজুল রহীম তাদের গায়ে হাত বুলায় এবং ভাবতে থাকে সে যদি কসাইভিটা এলাকার এই বিড়ালদুটিকে না পেত তবে তার অত্যন্ত কষ্টের দিনগুলি আর কোনদিন শেষ হতনা। আজিজুল রহীম এবার একইসাথে চাকরি আর লেখালেখিতে মননিবেশ করতে থাকে। ছুটির দিনে আরাম করে পড়েন আর লিখেন। পুরোনো পত্রিকা অফিসে যান, আড্ডাবাজি করেন। পুরোনো সহকর্মীরা তাকে দেখে খুশিই হন। আর এইসবের মধ্যে আজিজুল রহীমের মাথায় আবার বাজ পড়ে যখন তিনি শুনতে পান যে তার বাবা শফিকুল রহীম তার বিয়ে ঠিক করেছে। সে আবার প্রেস মালিক মিল্লাত হাজ্বী সাহেবের সাথে দেখা করে তাকে বিয়ের দাওয়াত দেয়। জবাবে মিল্লাত হাজ্বী তাকে ছাবসম্বোধন করে এবং দ্বিতীয়বারের মত আজিজুল রহীম ছাবএই মাঝারি মানের প্রেসে আমোদিত বোধ করেন। মিল্লাত হাজ্বী বিয়ের খাওয়া দাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করেন এবং ভাল বাবুর্চি আছে কিনা তাও জিজ্ঞাসা করেন- বুঝলেন ম্যানেজার ছাব, কাচ্চি খাওয়াইবেন নাকি তেহারি খাওয়াইবেন হেইডা আপ্নের আব্বাজানরে জিগায়েন, দুইটাই ভাল পাক করবার পারে আমার ভাতিজা, আঙুল চাটতে থাকবেন এমুন সোয়াদ আর উমদা বিরানি পাকায়, আল্লায় রহমত ঢাইলা দিচে ওর হাতেআজিজুল রহীম স্বস্তি বোধ করেন ছুটি ছাটার ব্যাপারে প্রেস মালিক কোন আপত্তি না করায় আবার বাবুর্চির ব্যাপারটাও তাকে কিছুটা ভাল বোধ করায় কেননা বিয়ের রান্না খারাপ হলে পুরা মহল্লায় নাম নষ্ট এবং মানুষ অনেকদিন মনে রাখে এসব ছোট খাট ব্যাপার সুতরাং এই ব্যাপারগুলা অতটা ছোটখাটও নয়। 


আজিজুল রহীম খুশিমনে কসাইভিটা যায় এবং খুশিমনে বিয়ে করে। বিয়েতে কাচ্চি খাওয়ায়, সাথে বোরহানি। কসাইভিটার লোকজন খুশি হয়, মিল্লাত হাজ্বী সাব মুচকি মুচকি হাসেন, সকল প্রশংসার ভাগীদার যে তিনি সেটা আকারে ইঙ্গিতে ইশারায় বলার চেষ্টা করেন এবং আজিজুল রহীমের বাবা শফিকুল রহীম তার হাতে বারবার চুমু খায়। বিয়ে শেষে ছুটি ছাটা শেষে আজিজুল রহীম তার নতুন বউ ইয়াসমিনকে নিয়ে তার সেগুনবাগিচার একরুমের বাসায় উঠেন, বাসায় সব সুবিধা তো আছেই তার সাথে আছে কসাইভিটার দুই পুরোনো বাসিন্দা- একটা মেনি বিড়াল আর একটা হুলো বিড়াল। এবং জনাব আজিজুল রহীমের দ্বিতীয়বারের মত রাইটার্স ব্লক এই সময়েই আসে। প্রথম প্রথম সে বুঝতে পারেনি, প্রতিদিনের মতই বকরখানি, চা খেয়ে ,কোন কোনদিন পরটা ভাজি কিংবা হালুয়া খেয়ে মাঝারি মানের প্রেসে যেত কিন্তু একদিন সে শুনতে পেল তার বউ আতঙ্কিত চেহারায় বেড়াল দুটিকে দুধ খাওয়াচ্ছে এবং পরিমানে অনেক বেশিই খাওয়াচ্ছে আবার কখনো কখনো দুটি ইলিশ মাছ আনলে আস্ত একটা ইলিশই ওদের খেতে দিত। আজিজুল রহীমের বেখাপ্পা লাগে ব্যাপারটা এবং ব্যাপারটা এতটাই বেখাপ্পা যে সে বুঝতে পারে তার বউ বেড়ালদের ভাষা বুঝে এবং তাদের সাথে কথা বলে। আজিজুল রহীম বউকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতেই বউ মাথা নিচু করে বসে থাকে এবং বলে বেড়ালদুটো তাকে অনেক আগে থেকেই চেনে, কসাইভিটায় তার পুরোনো শত্রু এই বেড়ালদুটো। আজিজুল রহীম বুঝতে পারে এক বিপদ থেকে বাঁচতে সে নতুন বিপদে পড়েছে এবং ভাবতে থাকে এই নতুন বিপদ থেকে সে কিভাবে পরিত্রাণ পাবে। 


তো এভাবেই কেটে যায় আজিজুল রহীমের দিন কিন্তু এভাবেই যদি কাটত তবে তাতে তো আর কোন আশঙ্কা থাকে না । আশঙ্কা তৈরীতে নতুন গল্প শুরু হল এবং তা লেখা শুরু করলেন আজিজুল রহীম তার রাইটার্স ব্লক ভেঙে। অফিস থেকে পাঁচদিন ছুটি নিয়ে আজিজুল রহীম লিখতে শুরু করলেন ইন্দুর বিলাইয়ের গল্প। তার টেবিলের উপরে বসে থাকে মেনি বেড়াল আর নিচে পায়ে ঘেষে শুয়ে পড়ে হুলো বেড়াল। আজিজুল রহীম লিখে যায় শুরু থেকে কিভাবে এনায়েতঙ্গঞ্জ থেকে এক ঝাক ইদুর তার নতুন বাড়িতে এসে পড়ল আর কিভাবে সে তাদের কথা শুনতে পারতেন তাও লেখা শুরু করলেন। পাঁচদিন পর গল্পের শেষে এসে তিনি জানতে পারলেন আজই তার লেখার শেষ দিন কিন্তু তিনি এখনো গল্প শেষ করতে পারেননি। আজিজুল রহীমের বউ তাকে শিখিয়ে দেয়, বলে- লিখেন, কিছুদিন পর এলাকায় চাউর হয় আজিজুল রহীমের বউ দুইটা মৃত সন্তান প্রসব করছে, এর মধ্যে একটা সাদা ইন্দুর আরেকটা কালা ইন্দুরআজিজুল রহীম ঘামতে থাকে বউয়ের এমন রসিকতায়, সে এটাকে রসিকতা হিসেবে নিতে পারেনা আবার স্বাভাবিক ভাবেও নিতে পারেনা। আজিজুল রহীম বিভ্রান্ত হয় এই গল্পে প্রথমবারের মত। তার বউ স্বাভাবিকভাবে চা বানিয়ে আনে, বলে- আমি পোয়াতি, আর এই মেনি বিলাইটাও পোয়াতি, মেনি বিলাইটা কইচে আমি যদি ওগো রোজ রোজ ইন্দুর আইনা না খিলাই তাইলে আমার পেটের বাচ্চা মইরা যাইবআজিজুল রহীম ক্ষিপ্ত হয়ে টেবিলের উপর থাকা মেনি বেড়ালটাকে পাশের ফুলদানি দিয়ে মাথায় বাড়ি দেয়, নিচের পা ঘেষা আধশোয়া হুলো বেড়াল আজিজুল রহীমের পায়ে আঁচড় কাটতে থাকে। আজিজুল রহীম এরপর রান্নাঘর থেকে বটি এনে হুলোটাকে এক কোপে দুই টুকরা করে। এসব দেখে ইয়াসমিন মূর্ছা যায়। আজিজুল রহীম ইয়াসমিনকে পাত্তা দেয়না। সে বাড়ি পরিষ্কার করে। বেড়ালদুটাকে বস্তায় ভরে পাশের নর্দমায় ফেলে। সে জানে এই কোন সময়ের উপকারী প্রানী দুইটা আজ তার জ্বালার কারণ আর তার বউয়ের মাথায় এই সব চিন্তার আগমন অন্তত এই সময়ের জন্য ভাল না। ইয়াসমিনের মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফেরায় আজিজুল রহীম, মুখে পানির ঝাপ্টা দেয়। ইয়াসমিন ডুকরে কেঁদে উঠে। ইয়াসমিন গোঙায় বলে- আমারে বিলাই দুইটা অভিশাপ দিব, আপ্নে এইটা কী করচেন?’ আজিজুল রহীম থম মেরে বসে থাকে এবং গল্পটা শেষ করতে পারেনা, তার রাইটার্স ব্লক আবার এসে হানা দেয়। 


এখন আজিজুল রহীম আর ইয়াসমিন জীবনে কোন সমস্যা অনুভব করেনা কিন্তু তা ঠিক কতদিন পর্যন্ত তা সম্বন্ধে আজিজুল রহীম নিশ্চিত হতে পারেনা। এভাবে সময় ঘনিয়ে আসে ইয়াসমিনের, ইয়াসমিনের প্রসব ব্যাথা উঠে। আজিজুল রহীম তাকে হাসপাতাল নিয়ে যায়। ডাক্তার পালস দেখে এবং অন্যান্য সব কিছু পরীক্ষা করে নিশ্চিত করে ইয়াসমিনের সব কিছু ঠিক ঠাক আছে। আজিজুল রহীম তারপরেও উদ্বেগে থাকে। এবং কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর ইয়াসমিন পরপর চারটা মৃত বাচ্চা প্রসব করে। এর মধ্যে একটা মেনি বেড়াল, একটা হুলো বেড়াল, একটা সাদা ইদুর আর একটা কালো ইদুর বলে ডাক্তাররা আজিজুল রহীমকে জানায়। ধীরে ধীরে পুরা সেগুনবাগিচা থেকে এনায়েতগঞ্জ আর কসাইভিটা পর্যন্ত চাউর হয় যে, ইয়াসমিনের গর্ভে এমন অবাস্তব কিছুর অস্তিত্ত্ব ছিল যাতে এইসব অকল্পনীয় ব্যাপার ঘটেছে এবং এতটা বেখাপ্পা খবর কসাইভিটা কিংবা এনায়েতগঞ্জ কিংবা সেগুনবাগিচার কেউ শুনেছে কিনা তা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি।

অতঃপর আজিাজুল রহীম শেষবারের মত তার রাইটার্স ব্লক ভাঙলেন এই লিখে যে - কিছুদিন পর এলাকায় চাউর হয় আজিজুল রহীমের বউ দুইটা মৃত সন্তান প্রসব করছে, এর মধ্যে একটা সাদা ইন্দুর আরেকটা কালা ইন্দুর সাথে আরো ছিল মেনি ও হুলোটাওআর এই গল্প শেষ করে আজিজুল রহীম যখন একটা সিগারেট ধরাবে তখন বাইরে সে দেখতে পাবে দুইটা বেড়ালের মিনমিনে হাসি, আজিজুল রহীম দরজা খুলে রাখে, বাড়িতে আবারো ইদুরের উৎপাত শুরু হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নিমাইকে ঘিরে কিছু প্রশ্ন

সময়টা তখনও দুপুর হয়নি,কৃষক নিমাইকে উষ্কখুষ্ক অবস্থায় মাঠে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কেউ হয়তো তাকে খেয়াল করছে, কেউ হয়তো করছে না। নিমাইয়ের পাশের ক্ষেতে চাষীরা কাজ করছে। এমন কর্মব্যস্ত দিনে নিমাইকে গালে হাত দিয়ে আকাশ পানে চেয়ে থাকতে দেখে কারো মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে, কারো হয়তো জাগছে না। পাশের ক্ষেতগুলোতে   কাজ করছে ভূমিহীন বর্গাচাষী ইদ্রিছ মিয়া,দীর্ঘদেহী সোলায়মান আর প্রাণেশ। তারা কেউ কেউ নিমাইয়ের কুশল জিজ্ঞাসা করে, কেউ করেনা।  নিমাই একজন বর্গাচাষী এবং অবশ্যই অস্বচ্ছল। অভাব অনটন যে তার এবং তার জাতের নিত্যসঙ্গী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্গাচাষীদের নিজের জমি থাকে না,অন্যের জমিতে তারা চাষ করে বিনিময়ে অর্ধেক অথবা তিন ভাগের এক ভাগ ফসল পায় এবং তা দিয়ে তাদের সারা বছরের অভাব কোনক্রমেই ঘুচে না। তাদের বছর বছর বংশ বৃদ্ধি পায়, প্রবীন একজনের হয়তো মৃত্যু হয়,যুবক আর কিশোরীদের বিয়ে হয়,যুবতী বোন হয়তো স্বামী পরিত্যাক্তা হয় কিন্তু তিন অক্ষরের অভাবটাই ঘুচে না।   নিমাইয়ের ঘরে স্বাভাবিকভাবেই হোক অথবা বাধ্য হয়েই হোক এক বউ। মুসলমান হলেও সে দুই অথবা তিন বউ রাখতে পারত না। এর জন্য আর্থিক সঙ্গতি...

দক্ষিণ মৈশুন্দি কিংবা ভূতের গলিতে মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে (2)

                          পর্ব ২- শেপালি মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে আমার কিংবা আমাদের পরিচয়ের প্রথম পর্বে শেফালির বিয়ে হয়ে যায়। আবার আমাদের সিদ্ধান্তেও আশা যাবেনা যে শেফালির বিয়ে হয়েছে , ওর তো বিয়ে হবার কথা ছিল, বিয়ে হয়েছিল কিনা সেটা আমরা এই গল্পের শেষে জানতে পারব , হয়তোবা পারবনা। আমরা কেউ শেফালির গ্রামের বাড়ির ঠিকানা না জানাতে ওর বিয়েতে উপস্থিত হতে পারিনি ব্যাপারটা আসলে এমন নয়, শেফালি কিংবা শেফালির বাবা আমাদের কাউকেই বলে যায়নি অথবা বিয়ের দাওয়াত আমরা পাইনি।  ভেজা হাত ধরতে ধরতে হঠাৎ একদিন আর জানালা খুলতে না পেরে আমি বুঝতে পারলাম হয়তো খুব ভোরেই শেফালি বাড়ি ছেড়েছে,শুধু জানতে পাইনি কিংবা জানতে পেরেও আমি পরেরদিন আমার নির্ধারিত সময়ে জানালায় হাত দেয়ার পরক্ষণেই এলাকার দোকানদার মন্ডল জানালো -'শেপালি তো গেছেগা, আন্ধার কাটোনের আগ দিয়াই গেছেগা'। আমি আগে থেকে জানতাম এমন ভাব করে বললাম-'হ, কইতাছিল যাইবগা, অর বাপে নিহি আইছিল, বুইড়া কইছে ওরে যেন না বিছড়াই'। মন্ডল আমার কথা বিশ্বাস করলো কী করলো না তার অপেক্ষায় না থেকে আমি পা বা...

ট্রলার

পান চিবাইতে চিবাইতে আব্দুর রহমান বাড়ি ফিরে। দুপুরে খাবারের পর সে নিয়ম করে ঘর থেকে বাইর হয়, তা যতই বৃষ্টি হোক কিংবা ঠাডা পড়া রোদই হোক না কেন, রশিদের দোকান থেকে সে পান কিনে, হালকা জর্দা দেয়া, একটু চুন সাথে সুপারি দেয়া অর্ধেক পান খাবে সে এবং শেষ পিকটা ফেলবে সে তার বাড়ির দরজার পাশের দেয়ালে আর এভাবেই ঐ দেয়ালটার নিচের সম্পূর্ণ অংশ সবসময় লাল হয়ে থাকে। আব্দুর রহমান চল্লিশোর্ধ্ব, কোন কারনে সে এলাকায় গরুর ব্যাপারী হিসেবে পরিচিত, তাকে সবাই আব্দুর রহমান বেপারী ডাকে, তবে লোকে তাকে কেন গরুর ব্যাপারী ভাবে সে আজো ঠাওর করতে পারেনা, কোনদিন ঘোর লাগা এক বর্ষার রাতে সে কলিমুদ্দি ব্যাপারীর সাথে তাস খেলতে খেলতে হয়তো গরুর বেপার নিয়ে দুই একটা কথা বলছিল তাতেই কি লোক তাকে ব্যাপারী নাম দিল নাকি তা নিয়ে সে প্রায়ই ভাবে এবং ভাবতে ভাবতে কোন কুল কিনারা না করতে পেরে মাছের ট্রলার আজো কেন ফিরল না সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। আব্দুর রহমানের আসল কাজ মিয়া বাড়ির আটটা ট্রলার দেখা শোনা করা, এবং এই এলাকায় যে আর কারো দুই একটার বেশি ট্রলার সে বাড়তে দেয়না এইটা জানার কারণে মিয়া বাড়ির বড় মিয়া তাকে বেশ স্নেহ করে আর এই স্নেহ মাঝে মধ্যে বাড়...