সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চূড়া

(এইটা হইতে পারে একটা বড় গল্পের প্রথম অংশ অথবা এই গল্প এইখানেই শেষ, মুডের উপর ডিপেন্ড করবে এইটা ইলাস্টিক হবে কি হবেনা)
তখনো ভোর হতে অনেক বাকি। আমার সাথের সবাই শুয়ে পড়েছে। কেউ কেউ হয়তো নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে যাচ্ছে,সারাদিনের অনেক না বলা কথা বলে যাচ্ছে এক নিঃশ্বাসে। আমি হারিকেনের আলোটা একটু কমিয়ে আনি, সারারাতে স্বম্বল অল্প কিছু কেরোসিন। কাল সকালে কম করে হলেও বিশ-পঁচিশ মাইল এই পাহাড়ি এলাকার ঢাল বেয়ে কেউ একটু কেরোসিন নিয়ে আসবে। আমাদের দলে সবাই তরুণ, আমিও তরুণ, । দলে আমি সবার বড়। আমার এই শরীরটার বয়স এখন বিয়াল্লিশ,মনে হয়তো বাকী ছেলেদের মত উচ্ছ্বাস নেই তবে যেকোন খেলায়, ধরি সেটা ফুটবল, আমাকে ওরা এখনো হিসেব করে চলে। আমি চুপচাপ ডায়রি লিখে যাচ্ছি, আর ছেলেরা ফিসফাস করেই যাচ্ছে। আমি ওদের ঘুমিয়ে পড়তে বলে আলোটা একেবারেই কমিয়ে আনি,হাতের কাছের ধাতব বস্তুটা আরো কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে যাই।

হাফিজ আমাকে সকালে ডেকে দেয়,আমি কিছুটা লজ্জা পাই। সাধারণত সবার আগে আমিই উঠি। কিছুটা দূরে দেখা যাচ্ছে পাকির ঝাঁক, আলোর তীব্রতা নেই,চারপাশটা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। আমরা হাত পা ঝাড়া দিয়ে এগুই। সবাই ক্লান্ত তবু থামতে জানে না। ছেলেরা মনোবলের পরীক্ষায় অনেক আগেই পাশ করেছে। ঢাল বেয়ে নামছি, আমাদের গাইড হরি। ও পাহাড়ের ছেলে, পড়েছে মিশনারি স্কুলে। এলাকায় আশার আগে ওর সাথে যোগাযোগ ছিল। এক ঘন্টা পরে আমরা একটু থামলাম। পাশেই ঝর্ণা, সবাই হাতমুখ ধুয়ে নিল। এভাবে আরো সাত আট মাইল হাঁটার পর হরি আমাদের ওর ঠাকুমার ঘরে নিয়ে গেল। পাহাড়ের সমতলে ছনের ছাউনি,ঘরে কাঠের চকি। বেড়ায় মস্ত বড় রামদা ঝুলছে,মানুষের ভয়ে নয়,বন্য প্রানী ভাল করে বললে বলা যায় শূয়োরের ভয়েই সবাই এখানে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে। হরি আমাকে জানায় এখানে সবাই শিকারি। কথা বলার আগে বাচ্চারা জানোয়ার ধরে,বাবা-মা শিকার শেখায় আগে,কাপড় পড়ায় পড়ে।

হরির ঠাকুমা আমাদের মশলা চা খাওয়ায় লাঠি বিস্কুট দিয়ে। এরকম লাঠি বিস্কুট নাকি হরির ছোটভাই সাহেবদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসে সপ্তাহান্তে। ও ওখানেই থাকে,কাজ করে। কিছুটা শহুরের গন্ধ এই বিস্কুটে। আমরা চুপচাপ খাই। বেশি কথা বললে ঠাকুমা হয়তো আমাদের কথা অন্য কাউকেও বলতে পারে,যদিও হরি নিশ্চিত হয়েই এসেছে ঠাকুমা আমাদের কথা কাউকে বলবে না,ঠাকুরদার দিব্ব্যি যে। ছেলেরা চা পান করে চাঙ্গা হয়। ঠাকুরমা সবাইকে পান সাধে,কিন্তু কারোই এসবের অভ্যেস নেই। দলের প্রায় সবাই শহুরে ছেলে, বাকিরাও মফস্বলে বড় হয়েছে। আমরা চা পানের পর আর দেরী করিনা। ঢাল বেয়ে আরো নামি, মাইল খানেক। বাজার বেশী দূরে না, হরি সামনে এগিয়ে যায় বাজারের লোকসমাগম দেখতে। আমরা কেউ কেউ অস্থির হই, আমি ছেলেদের বলি একটু ছড়িয়ে থাকতে যাতে কেউ এসে গেলেও সবাইকে এক সাথে দেখতে পারবে না।

হরি এসে যায়, বলে বাজারে লোক সমাগম কম। আমরা সবাই আর একটু অপেক্ষা করব। লোক সমাগম বাড়ার আগে আগে আমরা ছড়িয়ে পড়ি পুরো বাজারে। সবার কাঁধে ঝোলা, ঝোলায় শাক-সবজি ভরি, তেল নুন কিনি, মশলা কিনি। এমন সময় মোটর সাইকেল দাবড়িয়ে আসে আসগর চেয়ারম্যান, আমাদের মধ্য থেকে পাঁচটা দল তাকে ঘিরে বড় একটা বৃত্ত বানাই। আসগর চেয়ারম্যান বাজারে চায়ের দোকানে বসে, সম্ভবত বিচার আচার আছে। ধীরে ধীরে আমরা সামনে আসি,বড় বৃত্ত ছোট হয়।আমি ইচ্ছে করেই মুখে লুকোইনি, একশ মিটার দূর থেকে দেখছি বড় বৃত্তটির ছোট হওয়া। আসগর চেয়ারম্যানের সামনে গিয়ে হরি দাঁড়ায়, আসগরের চামচারা হরিকে দেখা মাত্রই ওর শার্টের কলার ধরে। ছোট বৃত্তটা আরো ছোট হয়, বাজারের লোকজন একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। চারপাশে একটা গুঞ্জন তৈরি হয়, আমরা গুঞ্জনটাকে আরো বাড়তে দেই। হরি চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে, আসগর বুনো পশুর মত হরির ওপর চড়াও হয়, ওকে জিজ্ঞেস করতে থাকে ও কোন সাহসে আবার এলাকায় ফিরে এসেছে। বৃত্ত থেকে হুঙ্কার ছুটে আসে, আসগর শুনতে পায় ওকে বলা হচ্ছে থামার জন্য। আসগরের চামচারা এদিক,সেদিক তাকায় , চারপাশে দশটা অচেনা মুখ। ওরা বুঝতে পারে, সবার সামনেই পথ বন্ধ, ওরা সন্দেহের চোখে তাকায় । ছেলেরা ঝোলা থেকে অস্ত্র বের করে, আমি দৌড়ে সামনে আসি, আমার হাতে স্টেনগান। আসগর হরির পায়ে পড়ে। ওর চামচারা থতমত হয়ে মাটিতে বসে পড়ে, কেউ লুঙ্গির গিটে হাত দেয় । ছেলেদের একজন তাকে থাপ্পর দেয়,লুঙ্গি থেকে অস্ত্র পড়ে যায়, দেশি অস্ত্র,জং ধরা নল। আমি হাসি, আমার স্টেনগানে উত্তপ্ত হাত, আসগরের মুখে একটা বাড়ি মারি। আসগর হাউমাউ করে কান্না শুরু করে, আমি আবার একটা লাথি দেই। হরি একজনকে ধরে আনে যে আসগরের বিপক্ষ দলের রাজনীতি করে কিন্তু আসগরের সাথে গলায় গলায় ভাব। ওরা একসাথে সরকারি চাল ,ডাল আর গম চুরি করে। এদের বাড়িতে নতুন টিন অথচ যাদের দরকার তারা পায় না। আমি আসগরকে একটি উঁচু স্থানে নিয়ে যাই। বাজারের লোকজনদের ছেলেরা জড়ো করে। আসগর চিৎকার করে ক্ষমা চায়, ও স্বীকার করে কিভাবে হরিদের দোকান আর জমি সে দখল করেছে। হরির ভাই আর হরিকে এলাকা ছাড়া করেছে।

আসগরের ছোট ভাই ছুটে আসে, একজন ওকে ধরে আনে বাঁধে আসগরের সাথে। আসগরের ছোট ভাইকে গাছের ডালের সাথে ঝোলানো হয়। এলাকায় সব মেয়েদের জীবনে যে নরকের অসহ্যতা নিয়ে এসেছিল। আসগরকে হরি ব্রাশফায়ার করে সবার সামনে। পার্টির নামে আমরা স্লোগান দেই, লোকজন আমাদের জায়গা করে দেয়। আমরা বাজার ফেলে সামনে এগিয়ে যাই। আমাদের নেই কোন বাহন, নেই পর্যাপ্ত লোকবল। আমরা শুধু আত্মবিশ্বাসে সামনে এগোই কারণ আমরা এইমাত্র এই এলাকার সবচেয়ে বড় গুন্ডাকে মেরেছি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নিমাইকে ঘিরে কিছু প্রশ্ন

সময়টা তখনও দুপুর হয়নি,কৃষক নিমাইকে উষ্কখুষ্ক অবস্থায় মাঠে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কেউ হয়তো তাকে খেয়াল করছে, কেউ হয়তো করছে না। নিমাইয়ের পাশের ক্ষেতে চাষীরা কাজ করছে। এমন কর্মব্যস্ত দিনে নিমাইকে গালে হাত দিয়ে আকাশ পানে চেয়ে থাকতে দেখে কারো মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে, কারো হয়তো জাগছে না। পাশের ক্ষেতগুলোতে   কাজ করছে ভূমিহীন বর্গাচাষী ইদ্রিছ মিয়া,দীর্ঘদেহী সোলায়মান আর প্রাণেশ। তারা কেউ কেউ নিমাইয়ের কুশল জিজ্ঞাসা করে, কেউ করেনা।  নিমাই একজন বর্গাচাষী এবং অবশ্যই অস্বচ্ছল। অভাব অনটন যে তার এবং তার জাতের নিত্যসঙ্গী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্গাচাষীদের নিজের জমি থাকে না,অন্যের জমিতে তারা চাষ করে বিনিময়ে অর্ধেক অথবা তিন ভাগের এক ভাগ ফসল পায় এবং তা দিয়ে তাদের সারা বছরের অভাব কোনক্রমেই ঘুচে না। তাদের বছর বছর বংশ বৃদ্ধি পায়, প্রবীন একজনের হয়তো মৃত্যু হয়,যুবক আর কিশোরীদের বিয়ে হয়,যুবতী বোন হয়তো স্বামী পরিত্যাক্তা হয় কিন্তু তিন অক্ষরের অভাবটাই ঘুচে না।   নিমাইয়ের ঘরে স্বাভাবিকভাবেই হোক অথবা বাধ্য হয়েই হোক এক বউ। মুসলমান হলেও সে দুই অথবা তিন বউ রাখতে পারত না। এর জন্য আর্থিক সঙ্গতি...

দক্ষিণ মৈশুন্দি কিংবা ভূতের গলিতে মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে (2)

                          পর্ব ২- শেপালি মোহাম্মদ শহীদুল হক সাবের সাথে আমার কিংবা আমাদের পরিচয়ের প্রথম পর্বে শেফালির বিয়ে হয়ে যায়। আবার আমাদের সিদ্ধান্তেও আশা যাবেনা যে শেফালির বিয়ে হয়েছে , ওর তো বিয়ে হবার কথা ছিল, বিয়ে হয়েছিল কিনা সেটা আমরা এই গল্পের শেষে জানতে পারব , হয়তোবা পারবনা। আমরা কেউ শেফালির গ্রামের বাড়ির ঠিকানা না জানাতে ওর বিয়েতে উপস্থিত হতে পারিনি ব্যাপারটা আসলে এমন নয়, শেফালি কিংবা শেফালির বাবা আমাদের কাউকেই বলে যায়নি অথবা বিয়ের দাওয়াত আমরা পাইনি।  ভেজা হাত ধরতে ধরতে হঠাৎ একদিন আর জানালা খুলতে না পেরে আমি বুঝতে পারলাম হয়তো খুব ভোরেই শেফালি বাড়ি ছেড়েছে,শুধু জানতে পাইনি কিংবা জানতে পেরেও আমি পরেরদিন আমার নির্ধারিত সময়ে জানালায় হাত দেয়ার পরক্ষণেই এলাকার দোকানদার মন্ডল জানালো -'শেপালি তো গেছেগা, আন্ধার কাটোনের আগ দিয়াই গেছেগা'। আমি আগে থেকে জানতাম এমন ভাব করে বললাম-'হ, কইতাছিল যাইবগা, অর বাপে নিহি আইছিল, বুইড়া কইছে ওরে যেন না বিছড়াই'। মন্ডল আমার কথা বিশ্বাস করলো কী করলো না তার অপেক্ষায় না থেকে আমি পা বা...

ট্রলার

পান চিবাইতে চিবাইতে আব্দুর রহমান বাড়ি ফিরে। দুপুরে খাবারের পর সে নিয়ম করে ঘর থেকে বাইর হয়, তা যতই বৃষ্টি হোক কিংবা ঠাডা পড়া রোদই হোক না কেন, রশিদের দোকান থেকে সে পান কিনে, হালকা জর্দা দেয়া, একটু চুন সাথে সুপারি দেয়া অর্ধেক পান খাবে সে এবং শেষ পিকটা ফেলবে সে তার বাড়ির দরজার পাশের দেয়ালে আর এভাবেই ঐ দেয়ালটার নিচের সম্পূর্ণ অংশ সবসময় লাল হয়ে থাকে। আব্দুর রহমান চল্লিশোর্ধ্ব, কোন কারনে সে এলাকায় গরুর ব্যাপারী হিসেবে পরিচিত, তাকে সবাই আব্দুর রহমান বেপারী ডাকে, তবে লোকে তাকে কেন গরুর ব্যাপারী ভাবে সে আজো ঠাওর করতে পারেনা, কোনদিন ঘোর লাগা এক বর্ষার রাতে সে কলিমুদ্দি ব্যাপারীর সাথে তাস খেলতে খেলতে হয়তো গরুর বেপার নিয়ে দুই একটা কথা বলছিল তাতেই কি লোক তাকে ব্যাপারী নাম দিল নাকি তা নিয়ে সে প্রায়ই ভাবে এবং ভাবতে ভাবতে কোন কুল কিনারা না করতে পেরে মাছের ট্রলার আজো কেন ফিরল না সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। আব্দুর রহমানের আসল কাজ মিয়া বাড়ির আটটা ট্রলার দেখা শোনা করা, এবং এই এলাকায় যে আর কারো দুই একটার বেশি ট্রলার সে বাড়তে দেয়না এইটা জানার কারণে মিয়া বাড়ির বড় মিয়া তাকে বেশ স্নেহ করে আর এই স্নেহ মাঝে মধ্যে বাড়...